
পশ্চীম বঙ্গ বোধ হয় শেষ ভারতীয় প্রদেশ যেখানে উচ্চ বর্ণ শাসন আজও চলছে। কিন্তু কিভাবে? বহুদলীয় গণতন্ত্রে কম জনসংখ্যা নিয়ে কোনো জাতির পক্ষে শাসন প্রায় অসম্ভব। নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে আস্তে আস্তে সমস্ত ভারতীয় প্রদেশে ধনী কৃষক জাতিগুলোর রাজনৈতিক আধিপত্য শুরু হয়েছে। তারা নিজেদের পরে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি বা ওবিসি হিসেবে ভারতীয় সরকারের দ্বারা নিজেদের নতিভূক্ত করিয়েছে। এই ধনী কৃষক জাতিগুলো বা ওবিসি-রা গ্রাম ভারতে ধনী শ্রেণির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আবার জনসংখ্যায়ও তারা যথেষ্ট। ভোটব্যাঙ্ক ও অর্থ মিলিয়ে গ্রাম দখল করেছে এই ওবিসি-রা, তা সে দক্ষিণ ভারত হোক বা মহারাষ্ট্র বা গুজারাত বা হিন্দি অঞ্চল। পঃ বঙ্গ একমাত্র ব্যতিক্রম কেন?
এর বড়ো কারণ ১৯৪৭-এ বাংলা ভাগের পরে পূঃ বঙ্গের সমস্ত উচ্চ বর্ণ পঃ বঙ্গে চলে আসে এবং এর ফলে পঃ বঙ্গে বাঙালি উচ্চ বর্ণের মোট জনসংখ্যার শেয়ার অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ৫% বেড়ে যায়। বাঙালি উচ্চ বর্ণ কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পঃ বাংলার ওবিসি-দের অর্থাৎ গ্রামীন ধনী শ্রেণি-কে অনেকটা দুর্বল রে দিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে পঃ বঙ্গের দলিত ও মুসলমানেরা মূলত গ্রামের দরিদ্র-দের মূল অংশ ছিল, এরা অধিকাংশই ওবিসি বা কিছু ধনী দলিত ও মুসলমানের জমিতে বর্গাদার ছিল। ফলে উচ্চ বর্ণের নেতৃত্বে ভূমি সংস্কার আন্দোলনে এরা প্রচণ্ডভাবে সাড়া দেয়। বলা যায় জমির জন্যই পঃ বঙ্গের দলিত ও মুসলমানেরা উচ্চ বর্ণ শাসন বজায় রাখে এবং ওবিসি উত্থান আটকে দেয়।
"ওপারেশন বর্গা"-র ফলে যখন গ্রাম পঃ বঙ্গের দলিত ও মুসলমানদের কিছুটা অর্থ হয় তখন আস্তে আস্তে নতুন সমীকরণ দেখা যায়। জমির মালিক ওবিসি বনাম বর্গাদার দলিত-মুসলমান-এর যে সমীকরণ ছিল তা আর রইলনা। অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল গ্রাম পঃ বঙ্গের মানুষ জমি ছাড়াও চাইল সরকারী চাকরী, রাজনীতি ও কন্ট্রাক্টরি।
সরকারী চাকরী-কে কেন্দ্র করে পঃ বঙ্গের মুসলমানেরা উচ্চ বর্ণ শাসকদের যখন চেপে ধরে তখন উচ্চ বর্ণ শাসকরা পঃ বঙ্গের রাজ্য সরকারী চাকরীতে ওবিসি-এ হিসেবে মুসলমানদের জায়গা দিয়ে দেয়। এর ফলে পুরনো ওবিসি-দের শুধু নয় দলিতদেরও ক্ষোভ গিয়ে পড়ল মুসলমানের ওপর। মুসলমানদের জনসংখ্যার শেয়ার ১৯৪৭-এ বাংলা ভাগের পরে কমে গেছিল ২৫% থেকে ১৮%। কিন্তু "ওপারেশন বর্গা"-র ফলে আর্থিক দুর্গতি কিছুটা দূর হওয়ায় পঃ বঙ্গের মুসলমানদের জনসংখ্যার শেয়ার ২০১১ সালে বেড়ে হয় ২৯%। আদম সুমারীর ফল বের হয়নি বটে, কিন্তু ইন্টারপোলেশন করলে বলা যায় পঃ বঙ্গে বর্তমানে মুসলমান সংখ্যা প্রায় ৩৩%। মুসলমান ভোট ব্যাঙ্ক-এর শক্তি বৃদ্ধি হওয়ায় পঃ বঙ্গের দলিত ও ওবিসি-রা মুসলমানদের ভোটব্যাঙ্কের নিরিখেও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। শুরু হয় সরকারী চাকরীর সংরক্ষণ ও রাজনীতি-কে কেন্দ্র করে দলিত-ওবিসি বনাম মুসলমানের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব উচ্চ বর্ণ শাসকদের চাপে ফেলে দেয়। কারণ ক্রমেই দলিত-ওবিসি জোট পঃ বঙ্গের উচ্চ বর্ণ শাসকদের মুসলমান তোষণকারী বলে দাবী করে। তারা বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে আকৃষ্ট হতে শুরু করে। তারা বুঝতে পারে যে শহরের বাড়তে থাকা হিন্দিভাষী জনতার সাথে হাত মেলাতে পারলে উচ্চ বর্ণদের হটিয়ে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে।
পঃ বঙ্গের শহরে আরেকটা ক্ষমতার সমীকরণ তৈরি হচ্ছিল। জমীদারী হারিয়ে যেখানে অধিকাংশ ভারতীয় প্রদেশে উচ্চ বর্ণ রাজনীতি-তে গুরুত্ব হারিয়েছে, সেখানে পঃ বঙ্গে উচ্চ বর্ণ আরও পাকাপাকিভাবে রাজনৈতিকাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল। ওবিসি উত্থান আটকে দিলেও বাঙালি উচ্চ বর্ণকে রাজনীতি ধরে রাখতে হয়েছিল ব্যবসায়ে মাড়োয়াড়ি-গুজারাতি আধিপত্য স্বীকার করে। বাঙালি উচ্চ বর্ণ জানত যে দিল্লি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে হিন্দিভাষী ভোটব্যাঙ্ক ও গুজারাতি মাড়োয়াড়ি পুঁজিপতিরা। দিল্লি কোলকাতার ব্যবসায়ে মাড়োয়াড়ি গুজারাতি আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে চাইবে। আর দিল্লির দাবী অস্বীকার করে বাঙালি উচ্চ বর্ণ টিকে থাকতে পারবেনা। তাই বাঙালি উচ্চ বর্ণ রাজনীতিবীদেরা সমস্ত ব্যবসা একে কে মাড়য়াড়ি গুজারাতি-দের হাতে ছেড়ে দেয়। মাড়োয়াড়ি পুঁজিপতিদের অর্থের ওপরেই নির্ভর করতে থাকে বাঙালি উচ্চ বর্ণ রাজনীতিবীদেরা কারণ ব্যবসা হারিয়ে তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই বলা যায় পঃ বঙ্গের আসল শাসক মাড়য়াড়ি গুজারাতি ব্যবসায়ীরাই আর বাঙালি উচ্চ বর্ণ রাজনৈতিক শাসকরা তাদের খেদমত খাটা চাকর মাত্র। মাড়োয়াড়ি গুজারাতি-রা তাদের ব্যবসা সুরক্ষিত রাখতে নির্ভর করতে থাকে আর এক হিন্দি প্রদেশ বিহার থেকে আগত লোকেদের ওপর। আর্থিকভাবে দুর্বল বাঙালি উচ্চ বর্ণরা নারীবাদে গাঁ ভাসায় ও সরকারী চাকরী করে জীবিকা নির্বাহ করতে চায়। ফলে তাদের জন্মহার কমতে থাকে। পঃ বঙ্গের শহরগুলোতে এই সুযোগে হিন্দিভাষিদের জনসংখ্যা বাড়তে থাকে।
বর্তমানে পঃ বঙ্গের ক্ষমতার সমীকরটা অনেকটা এরকমঃ
প্রথমেই আসবে মাড়োয়াড়ি গুজারাতি ব্যবসায়ী ও তাদের বিহারী শেপাই;
তারপরে আসবে বাঙালি উচ্চ বর্ণ রাজনীতিবীদেরা ও সেলিব্রিটিরা;
শেষে থাকবে মুসলমান (বাঙালি ও উর্দু), দলিত ও ওবিসি জনতা।
মুসলমান ও দলিত-ওবিসি-রা এখন প্রতিযোগিতা করছে সরকারী চাকরী ও রাজনীতি দখল করে কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা পেতে। বাঙালি উচ্চ বর্ণ বর্তমানে মূলত মুসলমান ভোটব্যাঙ্ক-এর ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে আছে। দলিত ও ওবিসি এবং হিন্দিভাষিদের কিছু অংশকে হরেকরকম সরকারী স্কিম দিয়ে নিজেদের দিকে নিয়ে এনে।
এবার প্রশ্ন সরকারী চাকরী ও রাজনীতি-কে কেন্দ্র করে মুসলমান বনাম দলিত-ওবিসি দ্বন্দ্ব কি বন্ধ করা যায়? উত্তর না। গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে সরকারী চাকরী ও রাজনীতি এখন প্রধান জীবিকা। তাই এই দ্বন্দ্ব বন্ধ হওয়ার নয়। এই দ্বন্দ্ব বন্ধ হতে পারে যদি নতুন কোনও জীবিকা এদের কাছে আসে। এবার প্রশ্ন পঃ বঙ্গের গ্রামের মুসলমান-দলিত-ওবিসি কি শহরের গুজারাতি মাড়োয়াড়ি করপোরেট ব্যবসা দখলে মন দেবে? যদি দেয় তাহলে অবশ্যই তাদের নিজেদের দ্বন্দ্ব ঘোচানো সম্ভব। কিন্তু পঃ বঙ্গের মুসলমান, দলিত ও ওবিসি মূলত পঃ বঙ্গের রাজনীতি দখলের দিকেই মন দিয়েছে। তাদের ব্যবসা দখলে মন নেই। এরই ফল ছিল ২০২১ সালে ওবিসি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে ওবিসি-দলিত ও হিন্দিভাষিরা বিজেপির হয়ে ভোট দিয়েছিল আর বাঙালি উচ্চ বর্ণ কেন্দ্রিক তৃণমূল ভোট পেয়েছিল পঃ বঙ্গের মুসলমানদের এবং নানা স্কিমের জোড়ে ভোট নিয়েছিল দলিত, ওবিসি ও হিন্দিভাষিদের কিছু অংশের। এরপরে ফুরফুরা মাজার-এর পরিবার উচ্চ বর্ণ শাসন শেষ করে দলিত ওবিসি মুসলমান জোট গড়ে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এর ফলে বাঙালি উচ্চ বর্ণ-এর একটা অংশ বিজেপি-তে ঢুকে দলিত ও ওবিসি -দের নেতা হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। বর্তমানে এইভাবেই ওবিসি দিলীপ ঘোষের জায়গায় পঃ বঙ্গের বিজেপির নেতা হয়ে গেছে উচ্চ বর্ণ সুভেন্দু অধিকারী ও সুকান্ত মজুমদার। এর থেকে বোঝা যায় বাঙালি উচ্চ বর্ণ-ও তার পোর্টফলিও বাড়াচ্ছে।
এগুলো থেকে স্পষ্ট যে পঃ বঙ্গের গ্রাম দ্রুতই হিন্দি (দলিত-ওবিসি) বনাম মুসলমান দ্বন্দ্বে চলে যাচ্ছে। যতদিন সরকারী চাকরী ও রাজনীতি প্রধান জীবিকা হিসেবে বিবেচ্য থাকবে, ততদিন এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকবে এবং এর শেষ পরিণতি হবে দাঙ্গা। কিন্তু যদি একথা বোঝানো যায় যে পঃ বঙ্গের আসল মালিক আসলে মাড়োয়াড়ি গুজারাতি ব্যবসায়ীরা আর বাঙালি উচ্চ বর্ণ শাসকেরা কেবলমাত্র তাদের খেদমত খাটা চাকর তাহলেই কেবল পঃ বঙ্গের মুসলমান দলিত ও ওবিসি এক হতে পারবে।
তাই বলাই যায় ব্রাক্ষণ্যবাদের (বাঙালি উচ্চ বর্ণ) বিরুদ্ধে লড়াই করে পঃ বঙ্গের মুসলমানেরা রাজনীতি দখল করতে চায় আবার রাজনীতি দখল-কে কেন্দ্র করেই পঃ বঙ্গের দলিত-ওবিসি-দের সাথে মুসলমানদের দ্বন্দ্ব। তাই ব্রাক্ষণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করলে এই মুহূর্তে কেবল কিছু মুসলমান ভোট থেকে উচ্চ বর্ণ তৃণমূল শাসকরা বঞ্চিত হবে এবং এর ফলে হিন্দিভাষী-বাঙালি দলিত-ওবিসি বিজেপি জোট জিতে যাবে। এবং বাঙালি উচ্চ বর্ণ এটা বুঝে বিজেপির নেতৃত্ব দখল করতে শুরু করেছে। ফলে পঃ বঙ্গের মুসলমান বেশি ব্রাক্ষণ্যবাদের সঙ্গে লড়তে গেলে দেখা যাবে তৃণমূল পরাজিত হয়ে বিজেপি এল এবং বাঙালি উচ্চ বর্ণ রাজনৈতিক শাসন অক্ষুন্ন রইল অথচ মুসলমানদের সম্পূর্ণ রূপে জমি ভেরী কন্ট্রক্টরি ব্যবসা থেকে ওবিসি-দলিতরা সরিয়ে দিল।
পঃ বঙ্গের মুসলমানদের প্রয়োজন বাঙ্গালিবাদ-কে সামনে রেখে মাড়োয়াড়ি গুজারাতি করপোরেট ব্যবসায়ীক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা। পঃ বঙ্গের বাঙালি হিন্দুদের যেই অংশটা গুজারাতি মাড়য়াড়ি বিহারীদের হটিয়ে শহরের ব্যবসা ও জীবিকা দখল করতে চায় তারা তখন মুসলমানদের সাথে হাত মেলাবে। তখন পঃ বঙ্গের মুসলমানেরা কিছু তো হারাবেই না, উলটে রাজনীতি ও শহরের ব্যবসা দুই-তেই লাভবান হবে।
মোদ্দা কথা হল মূল ক্ষমতার উৎস হল কর্পোরেট ব্যবসার পুঁজি। রাজনৈতিক শাসকেরা কেবল এই কর্পোরেটদের সেবাদাস। তাই মন দিতে হবে করপোরেট পুঁজি দখলে, রাজনীতি তাহলে আপনা আপনি হাতে আসবে।
Author: