শ্রীলংকার মার্ক্সবাদী সরকার সম্বন্ধে কিছু কথা


শ্রীলঙ্কায় বামপন্থী সরকার গঠন হওয়ার খবর তো শুনেছেন। আজ প্রথমবার রাষ্ট্রীয় বাজেট পেশ করল অনুরা দিশানায়েকে'র সরকার। এর মধ্যেই কয়েক মাস ধরে জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের দাম কমানো, দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের উপর থেকে ট্যাক্স তুলে নেওয়া, বিগত দক্ষিণপন্থী সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীদের অবৈধ সম্পত্তিগুলো বাজেয়াপ্ত করা-- এমন অনেক জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলঙ্কার বামপন্থী সরকার। এবার দেখে নেওয়া যাক তাদের রাষ্ট্রীয় বাজেটে কি কি রয়েছে:

- দেশের জিডিপির প্রায় ১০% শিক্ষাখাতে খরচের লক্ষ্য:

১. উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য সরকারি খাতে ১৩৫০০ কোটি টাকা খরচ।

২. কলেজ পড়ুয়াদের স্কলারশিপ মাথাপিছু ৫০০০/- থেকে বাড়িয়ে ৭৫০০/-।

২. সরকারি স্কুলে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য মাসে ১,৫০০/- করে স্কলারশিপ চালু।

৩. পাবলিক লাইব্রেরি'র খাতে ১০কোটি করে সরকারি বরাদ্দ।

৪. সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো উন্নত করতে ১০০কোটি এবং নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে ৫০কোটি সরকারি বরাদ্দ।

৫. পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও ক্যাম্পাসে স্পোর্টস অ্যাকাডেমি চালু করতে সরকারি বরাদ্দ ৫০ কোটি।

৬. স্মার্ট ক্লাসরুম ব্যবস্থা করতে বরাদ্দ ৮৬.৬ কোটি।

-স্বাস্থ্য খাতে ৬০৪০০ কোটির ব্যাপক বরাদ্দ বাড়ানো:

১. কিডনি পেশেন্ট'দের বার্ষিক চিকিৎসার জন্য মাথাপিছু ১০,০০০/- ভর্তুকি ও বার্ধক্যজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে মাথাপিছু ৫০০০/- ভর্তুকি সরকারি বরাদ্দ।

২. মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে ২৫ কোটি বরাদ্দ।

৩. শিশু ও মহিলা'দের চিকিৎসার সংক্রান্ত সরকারি ২০০ কোটি বরাদ্দ।

৪. স্কুল ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ১২০কোটি বরাদ্দ।

-গৃহহীন ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর জন্য নতুন আবাসন ও গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে ২৫০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা এবং চীনের 'গৃহহীনতা দূরিকরণ প্রকল্প'কে দেশের মাটিতে বলবৎ করা।

-শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি:

১. ক্ষেতমজুর ও দিনমজুরের দৈনিক আয় সর্বনিম্ন ১,৭০০/- বাধ্যতামূলক করা।

২. বেসরকারি কর্মীদের মাসিক বেতন এপ্রিল, ২০২৫ থেকে সর্বনিম্ন ২৭,০০০/- বাধ্যতামূলক এবং ২০২৬ সাল থেকে সেটা ৩০,০০০/- বাধ্যতামূলক করা।

৩. সরকারি কর্মচারীদের মাসিক বেতন সর্বনিম্ন ৪০,০০০/- বাধ্যতামূলক করা।

-পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ৫০০ কোটি সরকারি বরাদ্দ চালু করা।

-রেল পরিষেবা'র ক্ষেত্রে ১৫০ কোটি বরাদ্দ

১. পুরোনো কামরা-ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ২৫কোটি বরাদ্দ।

২. নুতন ইঞ্জিন তৈরিতে ৫০কোটি বরাদ্দ।

এছাড়াও কর্মসংস্থান, রেশন ব্যবস্থা, কৃষি, শিল্প, ট্যুরিজম, বন্দর-এর মত ৩৭টা খাতে সরকারি বরাদ্দ ঘোষণা করে নবনির্বাচিত শ্রীলঙ্কার বামপন্থী সরকার... প্রতি ক্ষেত্রেই স্বচ্ছ সোজাসাপ্টা হিসাব পেশ হয়েছে।

ভাবছেন স্বপ্ন দেখছেন? ভাবছেন কোনো সরকারের পক্ষে এটাও কি সম্ভব? ভাবছেন এমন ব্যবস্থাপনা মানে তো স্বর্গ!

কমিউনিস্টরা অলৌকিক স্বর্গে বিশ্বাস করেন না-
Anamul Haque Mony.
 

যেভাবে শ্রীলঙ্কার বামপন্থী দল National People's Power (NPP) মাত্র ৩টি আসন থেকে হঠাৎ করে ১৫৯ আসন পেয়ে দেশের সবচেয়ে বড় শাসক দলে পরিণত হলো:

১. ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে জনগণের ক্ষোভ

২০২২-২৩ সালে শ্রীলঙ্কায় তেল, বিদ্যুৎ, ওষুধ এবং খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতি।

রাজাপাকসে পরিবার এবং প্রচলিত দুই বড় দল (SLPP ও UNP/SJB) এই সংকটের জন্য দায়ী বলে জনগণ মনে করে।

জনগণ নতুন ও ক্লিন নেতৃত্ব খুঁজছিল।

২. দুর্নীতিবিরোধী ভাবমূর্তি ও “225 OUT” ক্যাম্পেইন

NPP নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েক দুর্নীতিবিরোধী দৃঢ় অবস্থানের জন্য পরিচিত।

“225 OUT” স্লোগানে পুরোনো সব সংসদ সদস্যকে বাদ দেওয়ার আহ্বান—ভোটারদের মন জয় করে।

৩. সুসংগঠিত তৃণমূল সংগঠন (Kottasha Sabha)

দেশের প্রতিটি জেলা, শহর ও গ্রামে স্থানীয় কমিটি গড়ে সংগঠন মজবুত করে।

নীচুস্তরে সরাসরি জনসংযোগ, স্থানীয় সমস্যার উপর কাজ এবং দরিদ্রদের পাশে থাকা।

৪. তরুণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন

বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ, প্রথমবারের ভোটার, পেশাজীবী ও শহুরে মধ্যবিত্তরা NPP‑র প্রতি আশাবাদী হয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার—TikTok, YouTube, Facebook লাইভে সক্রিয় উপস্থিতি।

৫. জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আস্থা অর্জন

তামিল, মুসলিম ও পাহাড়ি তামিল (ভারতীয় বংশোদ্ভূত) জনগণ ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে NPP‑কে ভোট দেয়।

NPP সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বলে এবং নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়।

৬. বিকল্প রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিষ্কার নীতিমালা

NPP–এর নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল: দুর্নীতি দমন, শিক্ষা সংস্কার, কৃষিতে আধুনিকীকরণ, পরিবেশ সুরক্ষা, ও শ্রমিক অধিকার।

ভোটের প্রচারে “সাধারণ মানুষের সরকার” গঠনের কথা বলে,, যা জনপ্রিয়তা পায়।

৭. প্রচলিত দলের ব্যর্থতা ও নেতৃত্বের প্রতি বিতৃষ্ণা

রাজাপাকসে পরিবার ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে মানুষের বিরক্তি তুঙ্গে।

“নতুন মুখ, নতুন আশা”—এই বার্তা দিয়েই NPP মাঠ জয় করে।

দুর্নীতি + দুর্দশা + পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা + সংগঠিত বিকল্প শক্তি = বামপন্থী দল NPP‑র বিস্ফোরণ।

বাংলাদেশে জুলাই২৪ পরবর্তী জন আকাঙ্খার সঙ্গে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার মিল রয়েছে অনেক। এজন্য ডানপন্থী-ইসলামপন্থী দল/জোটের শ্রীলঙ্কার NPP থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া উচিৎ।
سلطان احمد 

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like