Socialism Communism Xi Jinping Mao USSR China

গণতন্ত্র নয়, মেধা বা শ্রম অনুযায়ী প্রাপ্তি-কে প্রতিষ্ঠা করাটাই লক্ষ্যঃ প্রসঙ্গ বাংলাদেশের নির্বাচন না সংস্কার

04-June-2025 by east is rising 37

নির্বাচন আগে না সংস্কার আগেঃ এই হাসকর ডিবেট-এর কারণ হল বাংলাদেশের সমস্ত পক্ষ পশ্চীমা সাম্রাজ্যবাদের গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র বয়ান মেনে চলে।

বিএনপি আর ভারত বলছে নির্বাচিত সরকার চাই। এনসিপি ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে আগে সংস্কার করে ফের নির্বাচন করতে হবে। তা না হলে ২০০৮-এর নির্বাচন যেভাবে স্বৈরাচার ডেকে এনেছিল সেটাই আবার হবে। বিএনপি বলছে কোনও অনির্বাচিত সরকারের করা সংস্কার তারা মানবেনা। বরং নির্বাচনে বিজয়ী দল সংস্কার করবে। নির্বাচনে যাওয়ার আগে সংস্কার-এর বিষয়গুলো তুলে ধরবে সমস্ত দল। ফলে নির্বাচন হয়ে যাবে সংস্কারের পক্ষে ম্যান্ডেট। তাই নির্বাচন আগে, সংস্কার পরে।

ডিম আগে না মুর্গী আগে, এরকমভাবেই চলছে বাংলাদেশের রাজনীতির চর্চা। এই হাস্যকর ডিবেট-এর পেছনে লুকিয়ে আছে যে সমস্যা তা হল দুই পক্ষেরই ধারণা হল পৃথিবীটা বহু দলীয় গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র, এই দুই-এর মধ্যে বিভাজিত। পশ্চীম-এর দেশগুলো, ভারত হল আদর্শ গণতন্ত্র আর চীন রাশিয়া ইরান উত্তর কোরিয়া হল স্বৈরতন্ত্র। বাংলাদেশের দুই পক্ষই এই পশ্চীমা বয়ান বিশ্বাস করে। 

যদিও রাশিয়া আর ইরানে বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে কিন্তু শাসক পুতিন ও প্রধান বিরোধী দল রুশ কমিউনিস্ট পার্টি ভূ-রাজোনীতিতে মার্কিন বিরোধী অবস্থান নেয় বলে পশ্চীম রাশিয়া-কে স্বৈরতন্ত্রই বলে যায়। অন্য দিকে, ইরানে তৃতীয় চেম্বার গার্ডিয়ান কাউন্সিল বিভিন্ন দলের হয়ে নির্বাচনে কে দাঁড়াতে পারবে আর পারবেনা তা নির্ণয় করে দেয়। তাই পশ্চীমের ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ীরা নির্বাচনে নিজেরাও দাঁড়াতে পারেনা বা অন্য ব্যক্তিকে দাঁড় করাতে পারেনা। ফলে ইরানকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। 

আসলে বহু দলীয় নির্বাচনী গণতন্ত্র বনাম একদলীয় স্বৈরতন্ত্র-এর বয়ান তৈরি হয়েছে রুশ বিপ্লবের পরে। পশ্চীমের সাম্রাজ্যবাদী দেশুগুলো এই বয়ান তৈরি করে মূলত রুশ বিপ্লব-কে আটকাতে। এই তত্ত্ব আসলে কার্ল কাউতস্কির মতো লেনিন বিরোধী কমিউনিস্ট-এর তত্ত্ব যা পরে পশ্চীম গ্রহণ করে। কিন্তু এই গণতন্ত্র বনাম স্বৈরাচার তত্ত্ব আদৌ ঐতিহাসিকভাবে সঠিক নয়। ঐতিহাসিকভাবে পশ্চীমে গণতন্ত্র কখনোই শেষ লক্ষ্য হিসেবে আসেনি। পশ্চীমে নির্বাচনী গণতন্ত্র এসেছিল মূলত মেধা বা শ্রম অনুযায়ী প্রাপ্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে। অর্থাৎ লক্ষ্য হল মেধা বা শ্রম অনুযায়ী প্রাপ্তি আর গণতন্ত্র হল মাধ্যম। তাই প্রথমে ইংল্যান্ডে কেবল রাজাকে কর প্রদানকারী জমিদার, সামন্ত ও পদারীরাই নির্বাচিত করার ও নির্বাচনে দাঁড়াবার অধিকার পায় (১৬৮৯ সালে ইংল্যাণ্ডের জনসংখ্যার ০.৫%-এরও কম উচ্চবিত্ত শ্রেণি এই অধিকার পায়)। এরপরে ফরাসী বিপ্লব ১৭৮৯ সালে এসে বলে যে মধ্যবিত্ত (বুর্জোয়া)-রাই মূল কর প্রদানকারী আর তাই তাদেরই নির্বাচন করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার আছে। ফরাসী বিপ্লবের পরে গণতন্ত্রে স্থিতিশীলতা আসছিলনা বলে নেপোলিয়ন রাজতন্ত্র কায়েম করেন কিন্তু মেধা বা শ্রম অনুযায়ী প্রাপ্তিকে আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। নেপোলিয়নের পতন হলেও বিপ্লবী হাওয়া বইতেই থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডেও মধ্যবিত্ত-রা নির্বাচিত হওয়ার ও নির্বাচন করার অধিকার পায়। ১০ পাউন্ড বা তার বেশি কর দিলেই কেবল গণতান্ত্রিক অধিকার পায় ইংল্যাণ্ডবাসীরা। ফলে ১৮৩২ সালের পরে ৭.৫% ইংল্যাণ্ডবাসী গণতান্ত্রিক অধিকার পায়। এর পরে আসে কার্ল মার্ক্স এবং তিনি দেখান যে বুর্জোয়ারা যে কর দেন তা দিতে পারেন মুনাফা করে এবং মুনাফা তারা করতে পারেন শ্রমিক শ্রেণি শ্রম দেয় বলেই। ফলে শ্রমিক শ্রেণির গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষেও আওয়াজ উঠিতে থাকে। ১৮৫৬-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ১৮৬৭-তে যুক্তরাজ্যে শ্রমিক পুরুষ অধিকার পায় গণতন্ত্রের। অর্থাৎ সমাজের প্রতিটা শ্রেণি ধাপে ধাপে প্রমাণ করেছে যে তারা সামাজিক উৎপাদন ও রাষ্ট্রের আয়ের মূল ভিত্তি এবং তার জোড়েই তারা গণতান্ত্রিক অধিকার দাবি করেছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র তাদের আয়ের টাকায় চলে আর তাই রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে তাদের চাওয়াকে গুরুত্ব দিতে হবে রাষ্ট্রকে।

মজার ব্যাপার এই ধারা মেনেই রুশ বিপ্লব হয় এবং তারা জমিদারী উচ্ছ্বেদ ও দ্রুত শিল্পায়ণ কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে যায়। রুশ বিপ্লবের মত ছিল বিপ্লবী দল-এর শাসনে মেধা বা শ্রম অনুযায়ী অনুযায়ী প্রাপ্তিকে অনেক গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় যা বহু দলীয় শাসনে যায়না। কারণ বহুদলীয় শাসনে উচ্চবিত্ত-রা নির্বাচনে অর্থ দিয়ে নির্বাচিতদের নিয়ন্ত্রণ করবে এবং মেধা বা শ্রম অনুযায়ী অনুযায়ী প্রাপ্তিকে প্রতিষ্ঠিত করার বদলে নিজেদের লুট বজায় রাখতে চাইবে। রুশ বিপ্লবের মতে জমিদার ও পুঁজিপতিদের অর্থ দখল করে তা শিল্পায়ণ কর্মসূচীতে বিনিয়োগ করলে অনেক দ্রুত শিল্পায়ণ বাস্তবায়িত করা যাবে। আর বিদেশী আঘাত সামলাতে বানানো যাবে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকলে উচ্চবিত্তরা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে লুট করবে এবং তা থেকে বিভিন্ন বিলাসবহুল পণ্য ও পরিষেবা কিনতে যাবে। ফলে শিল্পায়ণ কর্মসূচী সেভাবে এগোতে পারবেনা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তৈরি হওয়া দেশগুলো যারাই পশ্চীমা সাম্রাজ্যবাদের গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র বয়ান মেনে এগিয়েছে, তারাই শেষ পর্যন্ত লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণির খপ্পরে গিয়ে পড়েছে। তারা না করেছে দ্রুত শিল্পায়ণ, না করেছে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। তারা কেবল দেশের সস্তা শ্রমকে শোষণ করে মুনাফা করেছে এবং মুনাফার অধিকাংশ হয় জমা করেছে পশ্চীমা ব্যাঙ্কে নয় কিনেছে বিলাসবহুল পণ্য ও পরিষেবা। এভাবেই দেশের সস্তা শ্রম শোষণ করে চলে লুটেরা পুঁজি। কিন্তু শ্রমিকদের মান ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কোনও বিনিয়োগ করেনা। ফলে দেশ সস্তা শ্রমিকের দেশই থেকে যায়। বাংলাদেশের আজ এরকমই অবস্থা হতে চলেছে। যেখানে লুটেরা পুঁজিকে ক্ষমতাচ্যুত করে উৎপাদনশীল শ্রেণিগুলোকে ক্ষমতায় আনা মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সেখানে লুটেরা পুঁজি ও পশ্চীমা সাম্রাজ্যবাদের বয়ান "গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র"-এর গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে। এই বয়ান থেকে যতদিন না বের হতে পারছে, তত দিন বাংলাদেশ বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেনা।

Author: Saikat Bhattacharya


You may also like