
অন্ধ ভক্তের দল বেশ কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়া এবং মুখে মুখে প্রচার করে চলেছে, ওদের মহান নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী না থাকলে, পশ্চিমবঙ্গ নাকি পাকিস্তানের হয়ে যেত ! কিন্তু বাস্তবতা কি, তারা আদৌ জানে ??
অথচ বঙ্গীয় বিধানসভা নির্বাচনে, তাঁর দল (হিন্দু মহাসভা) 1946 সালে পেয়েছিল 10 শতাংশেরও কম ভোট, আর 1952 সালে তাঁর নতুন তৈরী দল (জনসঙ্ঘ) পেয়েছিল 5,58 শতাংশ ভোট। 1946 সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বাংলা প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সুরাবর্দি। সুরাবর্দি ও শরত বসু (নেতাজীর দাদা) বাংলা ভাগ চান নি। ওনারা ছিলেন, অখণ্ড বাংলার পক্ষে। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু শ্যামাপ্রসাদ, বৃটিশদের সাথে চক্রান্ত করে বাংলাভাগের পক্ষে রায় দেন! পঃবঃ তৈরীর এমন মহান নজির তৈরী করার পরেও, হিন্দু বাঙালীর কাছে ১৯৫২ সালে তাঁর জনপ্রিয়তা কি ছিল, এই পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত। আসলে গোটাটাই ঐতিহাসিক ঢপ ছাড়া আর কিছুই নয়। অশিক্ষিত গোশাবকদের জন্য, নাগপুরের তৈরী সঙ্ঘী টনিক।
* উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি সারা জীবন ব্রিটিশদের দালালি করেগেছেন, এটাই ওনার আসল পরিচয়। বাবা আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নাম এবং রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে। উপাচার্য পদে থাকাকালীন, উনি 'ডি লিট' উপাধির জন্য নিজের নাম প্রস্তাব করেন বৃটিশ প্রভুদের কাছে এবং তা অর্জন করেন !!
** কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবসে ছাত্রদের নিয়ে তৈরি University Training Corps কুচকাওয়াজ করতো। সেই সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছাত্রদের হুকুম করেন, বৃটিশদের পতাকাকে অভিবাদন করতে হবে। ছাত্ররা প্রতিবাদ জানালে, শ্যামাপ্রসাদ তাদেরকে চাবুক মারার আদেশ করেন। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্ররা এবং ধর্মঘট শুরু করে। শ্যামাপ্রসাদ দুজন ছাত্রনেতা ধরিত্রী গাঙ্গুলী ও উমাপদ মজুমদারকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। এর বিরুদ্ধে সমস্ত ছাত্ররা মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ঘেরাও করে এবং ছাত্র আন্দোলনের চাপে, সিন্ডিকেট তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে।
*** শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কোনোদিন বৃটিশদের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন নি। তিনি সবসময়ই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সুবিধার জন্য হিন্দু-মুসলমান বিভেদের চেষ্টা করতেন।
1939 সালে বৃটিশরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরলে, বাংলায় কংগ্রেসের সব নির্বাচিত সদস্য প্রাদেশিক সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেয়।
কিন্তু ক্ষমতা লোভী শ্যামাপ্রসাদ ইস্তফা না দিয়ে, সাভারকারের কথায় কংগ্রেস ত্যাগ করে হিন্দু মহাসভাতে যোগ দেয়। এবং পাকিস্তানের প্রস্তাব উত্থাপনকারী, ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের সাথে 1941 সালে জোট করে, বাংলায় জোট সরকার তৈরি করে এবং উপমুখ্যমন্ত্রীসহ অর্থ দফতরের দায়িত্ব নেয়। ভারতে ধান্ধাবাজের রাজনীতি আমদানির জনক হচ্ছে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। বৃটিশ শাসনে যেমন মুসলিম লীগের সাথে জোট করে বাংলার উপ-মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ছিলেন, পাকিস্তানের প্রথম সরাস্ট্র মন্ত্রী ফজলুল হকের নেতৃত্বে! তেমনি স্বাধীনতার পরে জহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভায় তিন বছর মন্ত্রী ছিলেন তিনি !!
**** 1942 সালে শ্যামাপ্রসাদ, RSS-এর সাভারকরের সাথে হাত মিলিয়ে "ভারত ছাড়ো আন্দোলন" বয়কট করেছিলেন এবং এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচার সংগঠিত করেছিলেন। ভারতীয়দের কাছে আবেদন করেছিলেন - নিজেদের প্রদেশের রক্ষনাবেক্ষনের স্বার্থেই বৃটিশদের বিশ্বাস করা উচিত্। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে তিনি বলেছিলেন, "বাংলাতে কিভাবে এই আন্দোলনকে প্রতিরোধ করা যাবে ?? বাংলাতে শাসনকার্য এমনভাবে চালানো উচিত্, যাতে এই আন্দোলন বাংলাতে শিকর না গাড়তে পারে। আমরা, বিশেষত দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা যেন জনগণকে বলতে পারি, কংগ্রেস যে স্বাধীনতার আন্দোলন করছে - তা ইতিপূর্বেই জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে এসে গেছে" !!
***** জাতীয় কংগ্রেস ছিল একটি Common Platform - যেখানে মুসলিম লিগের মতো RSS, হিন্দু মহাসভার মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের লোকেরাও সদস্য ছিল। কিন্তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন, এইসব সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে, ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, যা স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই উনি কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার পরে, এইসব সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্যদের বলেন - "কংগ্রেসের সদস্য থাকতে হলে, কোনো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা যাবে না।"
নেতাজী জানতেন, সাম্প্রদায়িকতা এক মায়াবী বিষ। এই সাম্প্রদায়িকতার বিষের সম্পর্কে, তিনি জনগণকে সতর্ক করেছিলেন। এই বিষয়ে হিন্দু মহাসভার কার্যকরী সভাপতি শ্যামাপ্রসাদের সাথে নেতাজীর বিতর্ক হয়। আলোচনায় কাজ না হওয়ায়, হিন্দু মহাসভার সভাতে নেতাজীর অনুগামীরা হামলা শুরু করে এবং সভা ভন্ডুল করে দেয়। একটি সভায় শ্যামাপ্রসাদ বক্তব্য রাখতে উঠলে নেতাজীর অনুগামীরা ইটবৃষ্টি শুরু করতে, উনি আক্রান্ত ও আহত হন। এরপর 12ই মে 1940 নেতাজী ঝাড়গ্রামের জনসভায় বলেন - "হিন্দু মহাসভা ত্রিশূলধারী সন্ন্যাসীদের কাজে লাগাচ্ছে রাজনীতিতে জায়গা তৈরীর জন্য। হিন্দু ধর্মকে কাজে লাগিয়ে গৈরিক বসনের ভেকধারীদের দিয়ে, এরা ভোট চাইছে। কিন্তু তা করে, এরা শুধু হিন্দু ধর্মের অপমানই করছে না, তাকে অপবিত্রও করছে। সুতরাং, এইরূপ দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক তথা ধর্মদ্রোহী হিন্দু মহাসভা এবং হিন্দুত্ববাদীদের সমাজের থেকে বর্জন করা সকল হিন্দুর কর্তব্য।"
অনেকেই হয়ত ঘটনাগুলোকে কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন ! ঘটনাগুলি তেতো হলেও, চরম সত্যি। এই ঘটনাগুলির সত্যতা যাচাই করার জন্য ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে 14ই মে 1940 -এর আনন্দ বাজার পত্রিকার সংস্করণ দেখে নিতে পারেন। অথবা আপনাদের সঙঘী মহাপ্রভু শ্যামাপ্রসাদের লেখা - "রাষ্ট্র সংগ্রামের এক অধ্যায়", "Leave from the Diary" অথবা "Portrait of a Martyr - Biography of Dr. Shyama Prasad Mukherji by Balraj Madhok" পড়ে দেখতে পারেন।
লিখেছেন : Krishnendu Shil
Author: Saikat Bhattacharya