
প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর (পি. আর. ঠাকুর) ১৯৪৭ সালের ২০ শে জুন বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদে হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট ও শিল্পপতি ঘনশ্যাম দাস বিড়লা (জি. ডি. বিড়লা)- দের সমর্থন করে বাংলা ভাগের পক্ষে ভোট প্রদান করেন। ভেবেছিলেন বাংলার পিছিয়ে রাখা তপশিলি সমাজ পূর্ববঙ্গের মুসলীম মৌলবাদী শক্তির অত্যাচারের থেকে রেহাই পাবে এবং সেই সঙ্গে তাদের নাগরিক অধিকারও স্বীকৃত হবে।
এদিকে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাংলা ভাগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দিল্লী থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান---
১) বাংলা ভাগ সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোন সমাধান নয়।
২) বাংলা ভাগ হলে বাংলার তপশিলি সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়বে। একটি অংশ পূর্ববঙ্গের মুসলীম মৌলবাদীদের অত্যাচারের শিকার হবে, আর অপর অংশটি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মৌলবাদীদের অত্যাচারের শিকার হবে।
৩) বাংলার তপশিলি সমাজ রাজনৈতিক অস্তিত্বহীনতার দিকে অগ্রসর হবে।
সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে জিইয়ে রেখে "জন বিনিময়" (Exchange of Population) না করে ১৫ ই আগস্ট,১৯৪৭ ভারত ভাগ হয়ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় --- ভারত ও পাকিস্তান।
২০ শে ডিসেম্বর,১৯৪৯ অধুনা বাংলাদেশের বাগেরহাট মহকুমার কালসিরা গ্রামে পুলিশ কনস্টেবল হত্যাকে কেন্দ্র করে ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ তপশিলি, হিন্দু ও অহিন্দুরা নতুন ভারত ভূখণ্ডে আশ্রয়ের জন্য প্রবেশ করে। এদেরকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার পরিবর্তে ১৯৫০ সালের ৮ই এপ্রিল নেহেরু - লিয়াকত চুক্তি বা দিল্লী চুক্তি স্বাক্ষরিত করে আশ্রয়প্রার্থী তপশিলি, হিন্দু ও অহিন্দুদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে জোর করা হয়। কারণ নতুন ভারতবর্ষে নেহরু ও বিধান রায়েরা দেশ ভাগের বলি এই তপশিলি, হিন্দু ও অহিন্দুদের দায়িত্ব নিতে চাননি। অথচ এরাই দেশ ভাগের সময় গালভরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন যে, আজ যারা স্বাধীন ভারতের অংশীদার হতে পারল না, তারা যখনই ভারতবর্ষে আসবেন তাদেরকে দু - হাত তুলে সাদরে গ্রহণ করা হবে। Displaced Persons (Compensation and Rehabilitation) Act,1954 পাশ করা হলেও, দেশ ভাগের বলি এই ভিটেহারা মানুষগুলির কোনো পুনর্বাসন বা নাগরিকত্বের কোন সমাধান করা হল না। ভিটেহারাদের ন্যায্য দাবিকে নস্যাৎ করতে ২০০৫ সালে এই আইনকে বাতিল করে ভারত সরকার। যৎকিঞ্চিৎ বা করা হল, তাও হিন্দু হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গে ঠাঁই হলো না, ঠাঁই হলো বাংলার বাইরে দণ্ডকারণ্য, মালকানগিরি, গড়চিরোলি, আন্দামান, বেটিয়া প্রভৃতি দুর্গম অনুর্বর শাপদসঙ্কুল অঞ্চলে।
বাংলা ভাগের প্রাক্কালে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তাঁর মানুষদের হিন্দু হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসন ও ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। কিন্তু এরা কিছুই দেয়নি। উপরন্তু এই ভিটেহারা মানুষদের উপর জাতিবাদী কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট শাসকেরা অকথ্য অত্যাচার নামিয়ে আনে। এর প্রতিবাদে প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন। হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস প্রমথ রঞ্জন ঠাকুরের সাথে "বিশ্বাসঘাতকতা" (Betray) করেছিল। অপর দিকে মুসলীম লীগও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আসলে বহিরাগত আর্য ও বহিরাগত আশরাফরা শুধুমাত্র তাদের শ্রেণি স্বার্থকেই অক্ষুন্ন রাখতে ছিল বদ্ধপরিকর। ভারত ও বাংলাদেশে এই দুই শক্তি আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
ঠাকুর হরি - গুরুচাঁদের মানুষদের প্রতি এত বিদ্বেষ ও বঞ্চনা কেন ? কেনই বা তাদের ন্যায্য অধিকার --- ভারতীয় নাগরিকত্ব, ভোটাধিকার, সাংবিধানিক অধিকার ও মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে ? এর কারণ অনেক গভীরে ---
১) ঠাকুর হরিচাঁদ ১৮৩০ সালে বেদকে প্রত্যাখ্যান করে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে "সূক্ষ্ম সনাতন ধর্মে"র প্রচার - প্রসার শুরু করেন। ফলে তথাকথিত হিন্দু ধর্ম গাণিতিক সংখ্যায় আরও সংখ্যালঘু হওয়ার দিকে অগ্রসর হয়।
২) তৎকালীন হিন্দু "ভদ্দর লোক" কতৃক তাঁর সমাজের প্রতি অবজ্ঞা ও বঞ্চনার প্রতিবাদ স্বরূপ, তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্ব গান্ধিজি, সুরেন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, অম্বিকা চরণ প্রমুখের অনুরোধ সত্ত্বেও ঠাকুর গুরুচাঁদ তাঁর অনুগামীদের নিয়ে বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫), অসহযোগ (১৯২০), আইন অমান্য (১৯৩০) আন্দোলনে যোগদান করেননি। এমনকি বেঁচে থাকাকালীন জাতিবাদী কোন রাজনৈতিক দলে নাম লেখান নি। যদিও ঠাকুর গুরুচাঁদের চলে যাওয়ার পর, তাঁর নাতি প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসে যোগদান করেন।
৩) ১৯২৩ সালে খুলনা কনফারেন্সে ঠাকুর গুরুচাঁদের নির্দেশে ও অনুপ্রেরণায় আইডেন্টিটি পলিটিক্স (Identity Politics) - কে ভিত্তি করে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের নেতৃত্বে ১৯৩৮ সালে গঠিত হয় Independent Scheduled Caste Party। যা বাংলার "কিং মেকার" এ পরিনত হয়। এর ফলে হিন্দু ভদ্দর লোকেরা ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত একক ভাবে বাংলার প্রাদেশিক শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি।
৪) কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গিয়ে অবিভক্ত ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারে ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগের মনোনীত সদস্য হিসাবে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল আইনমন্ত্রী হন। যা কংগ্রেস মেনে নিতে পারেনি।
৫) তৎকালীন কংগ্রেসের সেকেন্ডম্যান হিন্দুত্বপন্থী নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নিষেধাজ্ঞা ও রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় বাবাসাহেব ড: আম্বেডকরকে ১৯৪৬ সালে বাংলা থেকে নির্বাচিত করে ভারতের গণপরিষদে পাঠিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ড: আম্বেডকর ভারতের সংবিধান রচনা করে সকল শ্রেণীর নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারকে সুরক্ষিত করেছিলেন
শৌর্য - বীর্যের অধিকারী গঙ্গরিডির এই মতুয়া নম: জাতি (যাদেরকে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার পর্য্যন্ত সমীহ করেছিলেন) যে কোন মুহূর্তে ভারতের তথা বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণকে বদলে দিতে পারে। তাই চক্রান্ত করে তাদের নাগরিকত্ব, ভোটাধিকার, সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকারকে হরণ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এই দেশের হিন্দুত্ববাদী জাতিবাদী শাসকেরা। বাংলাভাগ না হলে বাংলার তপশিলিদের আজ এই দশা বোধহয় হত না।
কলমে:- কিশোর কুমার বিশ্বাস।
সৌঃ Soumyadip Mahato
Author: Saikat Bhattacharya