
আজকে আপনাদের এমন একটা ভাষা নিয়ে আলোচনা করব যা প্রকৃতপক্ষে দ্রাভিড় ভাষাগোষ্ঠীর হলেও সুদূর বেলুচিস্তানের অন্যতম প্রধান ভাষা।
ব্রাহুই হলো দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর উত্তর দ্রাবিড় শাখার একটি ভাষা। এটি মূলত পাকিস্তান, ইরান, আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানে প্রচলিত। ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশে পাঞ্জাব রাজ্যে বিচ্ছিন্নভাবে ভাষাটি প্রচলিত হলেও পশ্চিমবঙ্গে কেবলমাত্র উত্তর দিনাজপুর জেলায় বসবাসকারী ইরানীয় জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে পারসী ছাড়াও এই ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এটি একটি দ্রাবিড় ভাষা হলেও দ্রাবিড় ভাষাসমূহের পীঠস্থান দক্ষিণ ভারত থেকে ভৌগোলিকভাবে ভাষাটি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। এই ভাষার নিজস্ব কোনো লিপি না থাকায় নাস্তালিক ও ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করে ভাষাটিকে লিখিত রূপ দেওয়া হয়। ভাষাটি প্রধানত পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশ এবং তার সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের হিরাট ও হেলমন্দ পার্বত্য এলাকায় প্রচলিত।
ব্রাহুই ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে নিকটবর্তী বালুচ ভাষার সাদৃশ্য পাওয়া গেলেও দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর অন্যান্য ভাষায় সেই বৈশিষ্ট্যগুলি অনুপস্থিত। ব্রাহুই ভাষার শব্দভাণ্ডার অনেকাংশেই বালুচ ভাষার দ্বারা প্রভাবিত, অথবা বালুচ ভাষা থেকে সরাসরি ব্রাহুই ভাষায় প্রবেশ করেছে। সাউথওয়ার্থ (২০১২) এর মতে, ব্রাহুই দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা নয়, এটি ‘জাগ্রোসিয়ান’ ভাষা পরিবারের একটি ভাষা, যার জন্ম দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায়, এবং এটি আর্যদের আগমনের পূর্বে ব্যাপকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাষার কোনো প্রকারের অস্তিত্বের কথা সেভাবে জানা না গেলেও ঝালওয়ানি ও সারওয়ানি নামে দুটি প্রকার (যথাক্রমে দক্ষিণ ও উত্তর) এই ভাষায় বর্তমান। পারসী, বালুচ ও পুস্ত ভাষা ব্রাহুই ভাষার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে।
ব্রাহুই জনজাতির মধ্যে তিনটি বিভাগ দেখা যায়, যাদের মধ্যে ঝালওয়ানি ও সারওয়ানি-এই দুটি বিভাগের জনসংখ্যা অধিক। ব্রাহুই জনজাতির মধ্যে বর্তমানে সর্বমোট ২৭টি উপজাতি রয়েছে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ই ট্রাম্প সর্বপ্রথম ব্রাহুই ভাষা ও জনজাতি সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য গবেষণার মাধ্যমে ভাষাটিকে কুরুখ ও মালতো ভাষার সঙ্গে একই উপশাখার অন্তর্ভুক্ত করেন। বর্তমানে ব্রাহুই ভাষার শব্দের মাত্র ১৫ শতাংশের উৎপত্তি দ্রাবিড় ভাষাসমূহ থেকে হয়েছে।
ব্রাহুই ভাষার স্বরবর্ণগুলি লং অর্থাৎ দীর্ঘ, শর্ট অর্থাৎ হ্রস্ব, এবং ডিপথং- এই তিনটি শ্রেণির হয়। ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে প্লোসিভ অথবা স্টপ, ন্যাসাল, ফ্রিকেটিভ, ল্যাটারাল, রোটিক ও গ্লাইড- এই প্রকারগুলির অস্তিত্ব রয়েছে। রেট্রোফ্লেক্সন ধর্মটি দেখা গেলেও পার্শ্ববর্তী অন্য ভাষার মতো অ্যাসপিরেশন ধর্মটি লক্ষ্য করা যায় না। নিকটবর্তী বালুচ ভাষার চেয়ে ব্রাহুই ভাষায় ফ্রিকেটিভ ও ন্যাসাল কনসোনেন্ট অর্থাৎ ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা বেশি। ব্রাহুই ভাষায় স্ট্রেস ‘কোয়ান্টিটি-বেসড-প্যাটার্ন’ অনুসরণ করে। সবসময় শব্দের প্রথম দীর্ঘস্বর অথবা ডিপথং এর উপর স্ট্রেস বসে। মূলত পাকিস্তানে ভাষাটি প্রচলিত, ইউনেস্কো ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহুই ভাষাকে পাকিস্তানের ২৭টি বিপন্ন ভাষার মধ্যে একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে এই জনজাতির বেশ কিছু মানুষের মধ্যে দ্বিভাষিক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে, এরা ব্রাহুই ও বালুচ- দুইটি ভাষাতেই পারদর্শী।
Author: Saikat Bhattacharya