
ভুল গড় শুল্ক নির্ধারণ
দেশ ভিত্তিক রেসিপ্রোকাল শুল্ক-এর অর্থ হল গড়ে ১০% বা তার বেশি শুল্ক কোনও দেশ মার্কিন পণ্য আমদানীর ওপর আরোপ করলে সেই দেশ থেকে যে কোনও পণ্য-তে গড়ে সেই দেশ যত শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছে তার অর্ধেক শুল্ক চাপানো হবে। অর্থাৎ কোনও দেশ গড়ে ২০% শুল্ক মার্কিন আমদানীতে ধার্য করলে সেই দেশজাত আমদানীর ওপর মার্কিন সরকার ১০% শুল্ক ধার্য করবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার ট্রাম্প যেভাবে কোনও দেশের গড় শুল্ক নির্ধারণ করেছে তা আদৌ গড় শুল্ক নয় বরং তা গাণিতিকভাবে হল- যে কোনও দেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য উদ্বৃত্তকে সেই দেশের মার্কিন বাজারে করা রপ্তানী দিয়ে ভাগ করা। অর্থাৎ মার্কিন বাজারে রপ্তানী বাড়ানোর সাথে যদি মার্কিন আমদানী বাড়িয়ে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমানো যায় তাহলে ট্রাম্পের চাপানো শুল্ক কমবে। আর কোনও দেশ যদি রপ্তানী ও বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বাড়ায় তাহলে ট্রাম্প শুল্কের হার বাড়াবে। অর্থাৎ এখানে ট্রাম্প আদৌ শুল্ক কমাতে বলছে না বরং বাজারের নিয়মকে অস্বীকার করে বলপূর্বক মার্কিন পণ্য চাপিয়ে দিতে চাইছে দুনিয়ার ওপর।
ধরা যাক ভিয়েতনাম-এর ক্ষেত্রে ট্রাম্প শুল্ক চাপিয়েছে ৪৬% কারন ভিয়েত্নামের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকে বাণিজ্য উদ্বৃত্তকে ভিয়েত্নামের মার্কিন বাজারে করা রপ্তানী দিয়ে ভাগ দিলে ০.৯ বা ৯০% হয়। অথচ ভিয়েতনামের মার্কিন আমদানীর ওপর গড় শুল্ক হল ৯.২% যা খুবই কম। ০%-এ নামালেও বাণিজ্য উদ্বৃত্তে কোনও হেরফের পড়বেনা। ট্রাম্পের ভুলভাল গড় শুল্ক গণনা করা হয়েছে এভাবেঃ বাণিজ্য উদব্রিত্ত/ রপ্তানী। ০% শুল্ক করলেও (বাণিজ্য উদব্রিত্ত/ রপ্তানী) অত্যন্ত উচ্চ থেকেই যেতে পারে। আর তাহলে ০.৫ x (বাণিজ্য উদব্রিত্ত/ রপ্তানী) উচ্চই থেকে যাবে। মার্কিন বাজারকে কেন্দ্র করে রপ্তানী কেন্দ্রীক অর্থনীতির দিন শেষ হল বলা যায়। এখন থেকে রপ্তানীর জন্য মার্কিন বাজারের বিকল্প বাজার খোঁজা এবং আভ্যন্তরীন বাজার বৃদ্ধি করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এর অনিবার্য পরিণতি কি? অনেক মানুষ বিশেষ করে ট্রাম্প নিজে প্রায়ই বলে বেড়াছেন যে এর ফলে বিদেশি আমদানী আর মার্কিন ক্রেতা কিনবেনা বরং দেশীয় বিকল্প পণ্য-এর ক্রেতা বাড়বে এবং মার্কিন উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
ট্রাম্পের শুল্ক কখনোই মার্কিন উতপাদন বাড়াবেনা বরং কমাবে
কিন্তু বিষয়টা এত সহজ না। শুল্ক চাপালে বিদেশি আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বাড়বে মার্কিন বাজারে। পণ্যের মূল্য বাড়লে, চাহিদা কমে। অর্থাৎ পণ্যের বাজার কমবে। যদি বাজারে মার্কিন বিকল্প আসেও তার মূল্য শুল্ক চাপানোর আগের আমদানীর চেয়ে বেশি হবে। ফলে চাহিদা ও বাজার কমছেই। তবে বেশি সম্ভাবনা অন্য কোনও দেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্য শুল্ক চাপানো দেশজাত পণ্যের বিকল্প হয়ে উঠবে। অবশ্যই তাহলেও পণ্যের মূল্য বাড়বে এবং বাজার কমবে। এতে কেবল শুল্ক চাপানো দেশের উৎপাদন অন্য দেশে চলে যাবে তাই নয়, মোট চাহিদা কমে যাওয়ায় নতুন উৎপাদনের দেশেও উৎপাদন কমবে আগের দেশে যত উৎপাদন হত সেই তুলনায়। ফলে বিশ্ব উৎপাদন কমবে। ফলে বিশ্বের আয় কমবে এবং এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব থেকে যে আয় করে তা কমবে। ফলে মার্কিন উৎপাদনও কমবে। বিশ্ব উৎপাদন ও মার্কিন উৎপাদন কমবে এবং মার্কিন বাজারে দ্রব্য মূল্য বাড়বে ফলে মুদ্রাস্ফীতি হবে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার বাড়বে। এর ফলে মার্কিন উৎপাদনে বিনিয়োগ কমবে আবার মার্কিন সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যবসা লাভজনক হয়ে উঠবে। বিশ্বের সমস্ত পুঁজি ছুটবে মার্কিন সম্পত্তি ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করতে ফলে মার্কিন ডলার-এর চাহিদা ও মূল্য বেড়ে যাবে। ফলে মার্কিন উৎপাদন-এর মূল্য বিশ্ব ও মার্কিন বাজারে আরও বেড়ে যাবে। ফলে মার্কিন উৎপাদনের চাহিদা কমে যাবে আর তাই মার্কিন উৎপাদনও কমে যাবে। তাই সব শেষে দেখা যাবে মার্কিন শুল্ক আরোপের ফলে উৎপাদন তো বাড়েইনি বরং কমে গেছে।
অনুন্নত দেশ কিভাবে ট্রাম্পের শুল্ক সামলাবে
এবার পরবর্তী সম্ভাবনায় আসি। যদি অন্যান্য দেশ মার্কিন আমদানীর ওপর ধার্য করা শুল্ক কমিয়ে দেয়? অর্থাৎ গড়ে ১০%-এর নীচে কমিয়ে দেয়? বা আগের চেয়ে কমিয়ে নিজের ওপর মার্কিন শুল্কও কমিয়ে দেয়? এখানে উন্নত বিশ্ব আর অনুন্নত বিশ্ব বা ঊচ্চ মূল্যের উৎপাদন ও নীম্ন মূল্যের উৎপাদন আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা হবে।
ধরা যাক বাংলাদেশের মতো একটা অনুন্নত দেশ যে গার্মেন্টস-এর মতো একটা নীম্ন মূল্যের উৎপাদন তৈরি করে বিশ্ব বাজারে বিক্রি করে। এখানে বিশ্ব বাজার বলতে প্রায় ৭০%-ই হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চীম ইউরোপ। ধরা যাক ৪০%-ই বিক্রি করে মার্কিন দেশে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ কি কিনতে পারে? অবশ্যই উচ্চ মূল্যের উৎপাদন বিশেষ যার মধ্যে কিছু বিলাসবহুল সামগ্রী আর কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী। বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশ কখনোই বিলাসবহুল সামগ্রী-তে বেশি খরচ করতে পারেনা। কারণ তাহলে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়ে যাবে আর দেশের উন্নতিতে কোনও কাজে লাগবেনা। যেমন বিলাসবহুল গাড়ি। মার্কিন জাত বিলাসবহুল গাড়ি-তে উচ্চ শুল্ক কমিয়েই কেবল মার্কিন আমদানীর ওপর ধার্য করা গড় শুল্ক কমাতে পারে বাংলাদেশ। অর্থাৎ মার্কিন বাজার থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় একই থেকে যাবে কিন্তু বাংলাদেশ বাজার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে নেবে। ফলে মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাবে বাংলাদেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এবার দেখা দরকার মার্কিন শুল্ক বাড়ার ফলে বাংলাদেশের কতটা মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমবে আর বাংলাদেশের ধার্য শুল্ক কমালে কতটা মোট বৈদেশিক আয় কমবে। যদি দেখা যায় শুল্ক কমিয়ে মার্কিন বিলাসবহুল পণ্যের ক্রয় বাড়ালে মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে যাচ্ছে তাহলে মার্কিন বিলাসবহুল পণ্যে শুল্ক কমানোর দরকার নেই। বরং মার্কিন বাজারের বিকল্প খোঁজা দরকার। এছাড়াও রপ্তানীতেও গার্মেন্টস ছাড়াও এমন পণ্য রপ্তানী করা দরকার যেগুলো মার্কিন মুলুক ছাড়াও অন্যত্র বিক্রি করা যাবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাজার বাড়ানো দরকার।
উন্নত দেশ কিভাবে ট্রাম্পের শুল্ক-কে সামলাবে
এবার আমরা জার্মানির মতো উন্নত দেশ নিয়ে আলোচনা করি। জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই উচ্চ মূল্যের উৎপাদন তৈরি করে। ফলে জার্মানি মার্কিন পণ্যে যদি শুল্ক কমিয়ে নিজেদের ওপর আরোপিত মার্কিন শুল্ক কমায় তাহলে কিছুটা হলেও মার্কিন উৎপাদনের চাহিদা জার্মানির বাজারে বাড়বে আর জার্মানির উৎপাদনের চাহিদা মার্কিন বাজারে একি থেকে যাবে। জার্মানির মোট বৈদেশিক আয় কমছে বটে কিন্তু তা মার্কিন পণ্যে শুল্ক না কমালে যে রেসিপ্রোকাল শুল্ক-এর মুখে পড়তে হচ্ছে তার থেকে কম না বেশি তা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিশ্ব যোগান/মূল্য শৃঙ্খল
এবার আসা যাক আরও গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব অর্থনীতির বিষয়ে। বিশ্ব অর্থনীতি আজ বিশ্ব মূল/যোগান শৃঙ্খল দ্বারা নির্মিত। প্রত্যেকটা দেশ এই শৃঙ্খলের সাথে যুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চীম ইউরোপ, জাপান, দঃ কোরিয়া বানায় উচ্চ মূল্যের সামগ্রী ও পরিষেবা। রাশিয়া আরব উপকূল ইত্যাদি বানায় তেল-গ্যাস। তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বানায় নীম্ন মূল্যের সামগ্রী ও পরিষেবা। তুর্কিয়ে ব্রাজিল মেক্সিকো ভিয়েতনাম মালেয়াশিয়া আরজেন্টিনা মধ্য মূল্যের উৎপাদন করে। চীন বর্তমানে উচ্চ, মধ্য এবং কিছু নীম্ন মূল্যের সামগ্রী ও পরিষেবা তৈরি করে। চীন ক্রমেই উচ্চ মূল্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করছে আর তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পঃ ইউরোপ, জাপানের জন্য প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করছে। মার্কিন সরকার ২০১৭ সাল থেকেই চেষ্টা করছিল চীন যাতে উচ্চ মূল্যের উৎপাদনে ঢুকতে না পারে। কিন্তু চীন ২০১৫ থেকে দশ বছর ব্যাপি পরিকল্পনা "মেড ইন চায়না, ২০২৫" করে উচ্চ মূল্যের উৎপাদনে ঢুকে পড়তে সক্ষম হয়। মার্কিন সরকারের আট বছর ব্যাপি চীনের বিরুদ্ধে চালানো বাণিজ্য যুদ্ধ ও প্রযুক্তি যুদ্ধ ব্যর্থ হয়।
চীনের বাজার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ক্ষমতা
কিন্তু চীন মার্কিন আরোপিত বাণিজ্য যুদ্ধ (শুল্ক বৃদ্ধি) ও প্রযুক্তি যুদ্ধ-তে বিজয়ী হল কিভাবে? চীন মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির সম্মুখীন হয় ২০১৭ সাল থেকে। কিন্তু তার অনেক আগে ২০১৩ সাল থেকেই চীন মার্কিন বাজারের বিকল্প তৈরি করা শুরু করে। ২০০৮-এর মন্দা চীনকে বুঝিয়ে দেয় মার্কিন ও পশ্চীম ইউরোপের বাজারের ওপর নির্ভর করে চলা ভুল হবে। তাই চীন বিকল্প বাজার তৈরি করা শুরু করে তৃতীয় বিশ্বে, আরব উপকূলে, রাশিয়াতে। আবার একই সাথে চীন দেশের অভ্যন্তরেও চাহিদা নির্মাণ শুরু করে মূলত অলাভজনক কিন্তু উৎপাদনমূলক পরিকাঠামো নির্মাণ করে। এই পরিকাঠামো নির্মাণ করতে যে বিশাল শ্রমিক লাগে ও অনুসারি শিল্পের প্রয়োজন হয় তার ফলে সমাজে নতুন চাহিদা ও বাজার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও উচ্চ প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করা, উচ্চ মূল্যের উৎপাদন উদ্ভাবন করার লক্ষ্যে চীন বিপুল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করে যা চীনের ভেতরে নতুন বাজার সৃষ্টি করে। ২০২৪-এ এসে দেখা যায় মার্কিন শুল্কের মুখে পড়েও বিশ্ব ম্যানুফ্যাকচারিং-এ চীনের শেয়ার ২০১৮-র তুলনায় ২০২৪ সালে ৪% বেড়ে ২৮% হয়ে গেছে। আবার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেড়ে হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইভি, সোলার প্যানেল, লিথিয়াম ব্যাটারি, ৭ ন্যানোমিটার বা তার বেশি ন্যানোমিটারের সেমিকন্ডাক্টর চিপ, উচ্চ গতির ট্রেন, স্পেস স্টেশন, ইত্যাদিতে বিশ্বে এক নম্বর হয়ে উঠেছে চীন। মনে রাখা দরকার তৃতীয় বিশ্বে বিকল্প বাজার তৈরি করার ক্ষেত্রেও চীন বিপুল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করে তৃতীয় বিশ্বের পরিকাঠামোয়। অর্থাৎ মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির মুখে পড়ে এমনকি তার আগে থেকেই বিশ্ব মন্দা দেখে চীন বিকল্প বাজার নির্মাণ করে ফেলে মূলত তার রাষ্ট্রীয় অলাভজনক কিন্তু উৎপাদনশীল বিনিয়োগ করে। এর ক্ষমতা বিশ্বে কেবল চীন বা ভিয়েতনামের আছে তারা সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়ায়। পরিকাঠামো, উচ্চ প্রযুক্তি, উচ্চ মূল্যের উদ্ভাবন-এ যে বিপুল অলাভজনক অথচ উৎপাদনশীল বিনিয়োগ করতে হয় তা মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে থাকা পুঁজিপতিরা করতে পারেনা।
ব্রেটনুডস চুক্তি (১৯৪৪-১৯৭১)
মনে রাখা দরকার ১৯৭১-এর ১৫ই অগাস্ট ব্রেটনুডস চুক্তির পতন হওয়ার পর থেকে পৃথিবীতে এক নতুন ধরণের অর্থনীতি গড়ে ওঠে যা ক্রমেই বিশ্বায়ণের রূপ পায়। ব্রেটনুডস চুক্তির মাধ্যমে সোনার দাম ও মার্কিন ডলারের মূল্য যে নির্দিষ্ট হারে বাঁধা ছিল তা ভেঙ্গে পড়ে। সাধারণত একটা মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করে সে কত শক্তিশালী অর্থনীতির প্রতিনিধি। অর্থনীতির শক্তি বুঝতে হবে এই দিয়ে যে সেই অর্থনীতি বহির্বিশ্ব থেকে কত নেট উপার্জন (রপ্তানী-আমদানী ও বিদেশে বসবাসরত মানুষ যে আয় দেশে পাঠায় - দেশে বসবাসরত বিদেশী যে আয় বিদেশে পাঠায়) করতে পারে, কত বিনিয়োগ ও ঋণ (বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণ যা দেশে আসে - দেশী বিনিয়োগ ও ঋণ যা বিদেশে যায়) টানতে পারে এবং এই দুই-এর ফলে কত বিদেশজাত সঞ্চয় আছে। এই সঞ্চয় মূলত থাকার কথা সোনা রূপা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ধাতুতে এবং বিদেশী মুদ্রার ভাণ্ডারে। ১৯৪৪ সালে যখন ব্রেটনুডস চুক্তি হয় তখন মার্কিনীদের ছিল বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং বিশাল সোনা ও বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে এসে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঃ ইউরোপের দেশগুলোর সাথে হয়ে গেছে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি। এবং এর ফলে ২৬ বছরে মার্কিন বৈদেশিক মুদ্রা ও সোনার সঞ্চয়ও অনেক কমে যাওয়ার কথা। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালে সোনার সঙ্গে মার্কিন ডলারের যে দাম বাঁধা ছিল তা ভেঙ্গে পড়ে।
ফাটকা পুঁজিবাদ (সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যবসা)-এর উত্থান
এই সময়ের পর থেকে মার্কিন ডলার আস্তে আস্তে তার মূল্য বাড়ানো শুরু করে তার সম্পত্তির ব্যবসায়ে বিদেশী বিনিয়োগ ও ঋণ টেনে এনে। মার্কিন সম্পত্তির চাহিদা যত বাড়তে থাকে মার্কিন ডলারের চাহিদা ও মূল্য তত বাড়তে থাকে। মার্কিন সম্পত্তির চাহিদা বাড়াতে, মার্কিন সম্পত্তি কেনাবেচা করার ব্যবসা সহজতর করতে হত। সেই মোতাবেক গ্লাস-স্টিগাল আইন তুলে দেওয়া হয় যা অনুতপাদনকারী সম্পত্তি কেনেবেচায় অতিরিক্ত বিনিয়োগ আটকাতো যাতে উৎপাদনকারী খাতে বেশি বিনিয়োগ হয়। ক্রমেই মার্কিন অর্থনীতি গোটা বিশ্ব থেকে ঋণ টেনে এনে সম্পত্তির মূল্য বাড়াতে থাকল এবং বর্ধিত মূল্যের সম্পত্তি কেনাবেচা করে মুনাফা করতে থাকল মার্কিন পুঁজিপতিরা। এই কৌশল আরও সহজ হয়ে গেল যখন চীন তার বিশাল শ্রমশক্তি নিয়ে বিশ্ব বাজারে হাজির হল। চীনের শ্রমিকরা ছিল তৃতীয় বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলোর তুলনায় বেশি দক্ষ (কারণ ১৯৪৯ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত চীনের বিশাল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিকাঠামো খাতে), অথচ তাদের মজুরি ছিল অধিকাংশ তৃতীয় বিশ্বের মতোই কম। উচ্চ দক্ষতা ও স্বল্প মজুরির যুগলবান্দী নিয়ে বিশাল চীনা শ্রমশক্তি বিশ্ব বাজারে এলে মার্কিন পুঁজিপতিরা সমস্ত উৎপাদনকারী শিল্প পাঠাতে শুরু করে চীনে। চীনের দক্ষ ও সস্তা শ্রমশক্তি সস্তা পণ্য তৈরি করে মার্কিন তথা বিশ্ব বাজারে ছাড়তে শুরু করে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি কমে যায় মার্কিন ও বিশ্ব বাজারে। এবং এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পঃ ইউরপ ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো সুদের হার কম রাখত যা ঝুঁকিপূর্ণ যে কোনও ব্যবসায়ে বিশেষ করে সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যবসায় বিপুল বিনিয়োগ টানতে সক্ষম হয়। বলা বাহুল্য এভাবে সম্পত্তির বাজারে বিপুল বিনিয়োগ টেনে এনে সম্পত্তির মূল্য বাড়িয়ে, সম্পত্তি কেনাবেচা করে মুনাফা করার ফল দাঁড়ায় সম্পত্তির মূল্য তার আসল মূল্যের চেয়ে অনেক গুণ বেড়ে যায় এবং এর ফলে সম্পত্তির বাজারে বুদবুদ তৈরি হয়, এক সময়ে বুদবুদ ফেটে যায়। তখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। মার্কিন ডলার সর্বাধিক ব্যবহৃত হলে মার্কিন সরকার বারবার বুদবুদ ফাটার পরে বিপুল মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে সম্পত্তির বাজারকে চাঙ্গা করতে পারলেও পঃ ইউরোপ ও জাপানের হাতে তত শক্তিশালী মুদ্রা না থাকায় তারা তা করতে ব্যর্থ হত। ফলে শক্তিশালী ডলার মার্কিন সম্পত্তির ফাটকা বাজারকে লাভজনক রাখত আর লাভজনক মার্কিন সম্পত্তির বাজার মার্কিন ডলারের চাহিদা ও মূল্য উচ্চ রাখত। চীন হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ব উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ব ফাটকাবাজীর প্রাণ কেন্দ্র। চীনের দক্ষ সস্তা শ্রম শক্তি মার্কিন শ্রমিকদের দর কষাকষির ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। মার্কিন শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় আর ক্রমেই মার্কিন জনতা ঋণ নিয়ে ভোগ করায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই মার্কিন অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ব চাহিদার প্রাণকেন্দ্র। শক্তিশালী সম্পত্তি হস্তান্তরের ব্যবসা ও উচ্চ ডলারের মূল্য মার্কিন মূলুকে উৎপাদন করা অলাভজনক করে ফেলে। ২০০৮ সালে মার্কিন ফাটকা বাজার ফাটার পরে দেখা যায় মার্কিন দেশে উচ্চ মূল্যের ও উচ্চ প্রযুক্তির কিছু উৎপাদন ছাড়া আর কিছু নেই। নীম্ন ও মধ্য মূল্যের অধিকাংশ উৎপাদনই চীনের হাতে। বিশ্ব উৎপাদনে মার্কিন শেয়ার বর্তমান মার্কিন ডলারে গুণলে দেখা যায় ১৯৭০ সালে যেখানে ছিল ৩৫%, ২০২৪ সালে তা হয়ে গেছে ২৬% আর চীনের শেয়ার ওই একই সময়ে ৩% থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭%। বিভিন্ন মুদ্রার ক্রয় ক্ষমতার সমতা ঘটিয়ে গুণলে দেখা যাবে বিশ্ব উৎপাদনে মার্কিন শেয়ার ১৯৭০ সালে ছিল ২৯% আর ২০২৪ সালে হয়েছে ১৫.৬%। চীন ওই একই সময়ে ৫% থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯.২%। তাই বলাই যায় যে চীনের আয় বেড়েছে শুধু তাই নয়, বিশ্ব উতপাদন থেকে যে বিশাল আয় চীন করে তার একটা বড় অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঋণ দেয় চীন (মার্কিন ট্রেসারি বিল কিনে)। ফলে মার্কিন সম্পত্তির বাজারে সবচেয়ে বড়ো বিনিয়োগকারী হয়ে দাঁড়ায় চীন। ২০০৮-এর মন্দার পড়ে তাই চীনই মার্কিন অর্থনীতিকে বেইল আউট করে।
শুরু হল চীন মার্কিন দ্বন্দ্ব
২০০৮ সালের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝে যায় তার সম্পত্তির বাজার চীনের ওপর নির্ভরশীল আর চীন বুঝে যায় তার উৎপাদন মার্কিন ঋণ কেন্দ্রিক চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করতে থাকে চীনের বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খোঁজার আর চীন চেষ্টা করতে থাকে রপ্তানী নির্ভরশীলতা কমিয়ে আভ্যন্তরীন চাহিদা বাড়াতে আর বিকল্প বাজার তৈরি করাতে। ২০০৮ সাল থেকেই পরিকাঠামোয় বিপুল রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ করে আভ্যন্তরীন চাহিদা নির্মাণ করতে থাকে, ২০১৩ সালে "বেল্ট এণ্ড রোড ইনিসিয়েটিভ" তৈরি করে চীন চেষ্টা করতে থাকে বিকল্প বাজার তৈরির আর ২০১৫ সালে "মেড ইন চায়না ২০২৫" তৈরি করে চেষ্টা করতে থাকে উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার। ২০১৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ ও প্রযুক্তি যুদ্ধ শুরু করেছে যার ফল নিয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি।
মার্কিন ডলারের অতিরিক্ত ব্যবহার ও মূল্য মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতির প্রধান কারণ
ট্রাম্প একদিকে বিশ্ব বাজারে মার্কিন ডলারের শক্তি অটুট রাখার কথা বলছে আর অন্যদিকে মার্কিন দেশে উৎপাদন ফিরিয়ে আনার কথা বলছে। দুটো এক সাথে হয়না। কারণ ডলারের উচ্চ মূল্য মার্কিন উৎপাদনকে বিশ্ব বাজারে উচ্চ মূল্যের করে দেয় আর তাই তার চাহিদা কম থেকে যায়। অন্যদিকে উচ্চ ডলার মূল্য মার্কিন সম্পত্তির মূল্যে বাড়িয়ে দেয় যা মার্কিন সম্পত্তির হস্তান্তরের ব্যবসাকে লাভজনক রাখে। আবার গ্লাস-স্টিগাল এক্ট-এর মতো আইন না থাকায় সমস্ত বিনিয়োগ যায় সম্পত্তি কেনাবেচা করে লাভ করতে, উৎপাদন কোনও বিনিয়োগ পায়না। এখন ট্রাম্প মার্কিন বাজারে বিদেশী পণ্য ঢুকতে না দিয়ে যেটা করছে তা হল মার্কিন অর্থনীতি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে মার্কিন বাজারে পণ্য রপ্তানী আদৌ লাভজনক থাকছেনা অধিকাংশ দেশের জন্য। মার্কিন বাজারের বিকল্প হিসেবে চীন রাশিয়া আরব উপকূল জাপান দঃ কোরিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তৃতীয় বিশ্বের ভেতরে খুঁজতে হবে যা চীন করতে পেরেছে শেষ ১২ বছরে। এছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে অলাভজনক উৎপাদনকারী বিনিয়োগ বাড়িয়ে আভ্যন্তরীন চাহিদা বাড়াতে হবে। এই অলাভজনক উৎপাদনকারী বিনিয়োগ কেবল রাষ্ট্রই করতে পারে (বা ইউনূস-এর তত্ত্বে বলা সামাজিক উদ্যোগীরা করতে পারে)। তাই বিদেশের বাজারে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের করা রপ্তানীর ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের করা পরিকাঠামো ও চাহিদা নির্মাণের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অর্থাৎ ট্রাম্প রপ্তানী নির্ভর বিশ্বায়ণ-কে অনেকটাই অর্থহীন করে দিল এবং তার সাথে রাষ্ট্র নির্ভর অর্থনীতি যা ১৯৪৫-৭৯ পর্যন্ত বিশ্বে ছিল তা ফিরে আসছে।
Author: Saikat Bhattacharya