
শশঙ্ক-র সময় থেকে সেন রাজা পর্যন্ত (৫৯৩-১১৯৩) ৬০০ বছর এরাই বাংলার স্বাধীন শাসক ছিল। কায়স্থ-রা মূলত রাজা সামন্ত জমিদার হত। ব্রাক্ষণরা হত শিক্ষক অধ্যাপক মন্ত্রী, বৈদ্যরা হত চিকিৎসক, বেনেরা হত ব্যবসায়ী। এরাই ছিল বর্তমান বিহারের দ্বারভাঙ্গা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এলিট সমাজ। ১১৯৩ সালে বখতিয়ার খিলজি-র আগমণে তারা প্রথমে পশ্চীম অংশে ও তার ৫০ বছর পরে পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতা হারায়। তবে বখতিয়ার মারা যাওয়ার পর থেকেই কাবাব-রা বুঝে যায় নব্য আগত তুর্কি আফঘান-দের সাথে জোট বাঁধার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তুর্কি আফঘানরা নগর জীবন পছন্দ করছে, নতুন নগর বানাচ্ছে, নতুন ব্যবসা ও প্রযুক্তি আনছে। তারা গ্রামে থাকতে পছন্দ করছেনা এবং গ্রাম থেকে খাজনা আদায় করার জন্যে কাবাব-দেরই স্মরণাপন্ন হচ্ছে। আইওয়াজ খিলজি যখন ১২১০ সালে দিল্লী সুলতান-কে অস্বীকার করে স্বাধীন লখনোউতি সালতানাত ঘোষণা করেন, কাবাব-রা বুঝে যায় তুর্কি-দের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তাদের পক্ষেই যাবে।
আইওয়াজ বেশি দিন দিল্লীর সামনে টিকতে না পারলেও কাবাব-রা তুর্কি-দের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের গন্ধ পেয়ে যায়। আস্তে আস্তে নব্য আগত তুর্কি আফঘান-দের সাথে জোট বাঁধা শুরু করে কাবাব-রা। দিল্লীতে জালালুদ্দীন খিলজি ও আলাউদ্দীন খিলজি ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে নীম্ন তুর্কিদের উত্থান হয় উচ্চ তুর্কিদের পতন হয়। আআলুদ্দীন খিলজি-কে বেদের দেবতা ইন্দ্র পুরন্ধর-এর সঙ্গে তুলনা করে ব্রাক্ষণ-রা শ্লোকও লেখে। তুঘলক শাসনকালে প্রদেশগুলোয় স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়। প্রথমে মোবারক শাহ ও পরে ইলিয়াস শাহ-র নেতৃত্বে বাংলা স্বাধীন সুলতানাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মনে রাখা দরকার ইলিয়াস শাহ-র স্ত্রী ছিলেন পুষ্পবতী ভট্টাচার্য (ইসলাম ধর্ম নেওয়ার পরে তার নাম হয় ফুল্লরা বেগম)। এছাড়াও ইলিয়াস শাহ-র হয়ে একডালা যুদ্ধে দিল্লির সাথে যুদ্ধ করেন অজস্র কাবাব সামন্ত ও সেনা যেমন- শিকাই সান্যাল, সুবুধিরাম ভাদুরী, জগানন্দ ভাদুরী ও কেশবরাম ভাদুরী। ইলিয়াস-এর নেতৃত্বেই তৈরি হয় স্বাধীন বাংলা সালতানাত ১৩৫৩-৫৬ সালে। জন্ম হয় বাঙালি মুসলমানের। বাংলা সালতানাতই প্রথম বাংলা ভাষা-কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়। তবে একথাও মনে রাখা দরকার দেক্কান বাহামণি সুলতানরাও তেলেগু ভাষা-কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছিল। বাহামণি নামটাই আসে ব্রাক্ষণ থেকে কারণ ব্রাক্ষন সন্তান হাসান গাঙ্গু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পরে বাহামণি সালতানাত বানায়। যাই হোক বাংলায় ফেরা যাক। পাল রাজাদের আমলে বাঙালি যখন বিশ্ব বৌদ্ধ ধর্মের প্রাণকেন্দ্র ছিল সেই সময়েও বাংলা হরফে সংস্কৃত লেখারই চল ছিল। বাংলা হরফে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা মূলত বাংলা সুলতান-দেরই কীর্তি। তবে বাংলা সালতানাত-এর অঙ্গ কাবাব-রা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। তাই রাজা গনেশও সালতানাত-এর ক্ষমতা নিয়ে নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেন। গণেশের পুত্র শাহজাদা যদুর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালুদ্দীন হওয়া প্রমাণ করে কাবাব-রা ইসলাম ধর্মও গ্রহণ করেছিল ব্যপক হারে ওই সময়ে। শেষ বাংলা সুলতান দাউদ খান কুররাণির প্রধান সেনাপতি ছিল রাজীব লোচন রায় যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হয়ে উঠেছিল কালাপাহাড়। ১৫৭৫-এর রাজমহলের যুদ্ধে কালাপাহাড় শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছিল বাংলা সালতানাতের হয়েই। বাংলা সালতানাতে (১৩৫৩-১৫৭৫) বাঙালি সুলতান ও অভিজাত-দের সঙ্গে কাবাব-দের একটা শক্তির ভারসাম্য ছিল।
১৫৭৫ থেকে ১৬১১-এর মধ্যে গোটা বাংলা দিল্লীর মোঘল বাদশাহর হাতে যায়। বাঙালি স্বাধীনতা হারায়। কাবাব-দের চোখে বাঙালি মুসলমান আর সার্বভৌম থাকলনা। যশোর ১৬১১ সালে পতন হয় এবং তারপর থেকে কাবাব-রা আর সেভাবে কখনো সামরিক শক্তি দেখাতে পারেনি। মোঘল আঘাতে তারা যুদ্ধ থেকে অনেকটাই সরে আসে। বহু বাঙালি মুসলমান এই সময়ে কৃষি কাজ শুরু করে। কাবাব-দের চোখে ক্রমেই বাঙালি মুসলমান সামাজিক স্ট্যাটাস হারায়। কাবাব-রা দিল্লী থেকে আগত অবাঙ্গালি মুসলমান ও রাজস্থানের হিন্দু-দের অধস্তন হয়ে যায়। শক্তির ভারসাম্যে কাবাব-রা খুবই দুর্বল ছিল। বাংলার ব্যবসাও চলে যাচ্ছিল মাড়োয়ারী তথা রাজস্থানীদের হাতে। শাসক অবাঙ্গালি মুসলমান-দের প্রতি ঘৃণা আর কৃষক বাঙালি মুসলমান-দের প্রতি তাচ্ছিল্য জন্মাতে থাকে কাবাব-দের মধ্যে। ১৭০৭ সালে ওউরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে দ্রুতই মোঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। মাড়োয়াড়ি উমি চাঁদ ও জগত শেঠদের সাথে ও উদীয়মান ইংরেজদের সাথে জোট বেঁধে ১৭৫৭ সালে ৫৫০ বছরের মুসলমান শাসন খতম করে বাঙালি কাবাব-দের একটা অংশ। মাড়োয়াড়ি-দের ক্ষমতা বাংলার ব্যবসায়ে বেড়ে যাওয়ার কথ ইংরেজরা আসার পরে। কিন্তু কাবাব-রা দারুণভাবে ইংরেজ-দের সাথে জোট বেঁধে বাঙলার ব্যবসা হাতে নিতে সক্ষম হয়। সেই ব্যবসার টাকায় চীরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এর জমিদারী কিনে বসে তারা। ১৮৫০ পর্যন্ত কাবাব-রা ব্যবসা-তে যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখায়। মেকলে-র মতে কাবাব-দের মতো ধৈর্যশীল বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী দঃ এশিয়াতে আর নেই। এসময় তারা বাংলার হস্তশিল্প শেষ করে, বাংলার কৃষি সমাজকে দারুনভাবে শোষণ করে। কেবল কোলকাতা বন্দরের গুরুত্বের ওপর নির্ভর করেই তাদের ব্যবসা চলছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুর এরকম সময়েই পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান। কিন্তু ১৮৫০-এর পরে যত পশ্চীম বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে শুরু করে ততই ভারতের পশ্চীমের বন্দরগুলোর গুরুত্ব বেড়ে যায় কোলকাতার তুলনায়। ব্যবসা হারাতে থাকে কাবাব-রা। সরকারী উচ্চপদস্থ চাকরীমুখী হয়ে যায় কাবাবরা। জ্ঞানে পারদর্শিতা দেখালেও ব্যবসায়ে বাংলাতে ক্রমেই মাড়োয়াড়িদের কাছে কোণঠাসা হয়ে যায় কাবাব-রা। ১৮৯০ থেকে কাবাব-রা মোটামুটি মূল ব্যবসা থেকে উৎখাত হয়ে যায় খোদ বাংলাতেই। মাড়োয়াড়ি-দের হাতেই ইংরেজরা বাংলার ব্যবসা তুলে দেয় ওই সময় থেকেই।
১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গ করতে চাইলে কাবাব-রা বাঁধা দেয় শেষ সম্বল পূর্ব বঙ্গের জমিদারী টিকিয়ে রাখতে। সরকারী চাকরী টিকিয়ে রাখতে মুসলমান কৃষক-দের পড়াশুনোরও বিরোধিতা করে কাবাব-রা। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ আটকানো গেলেও বিহার উরিশ্যা আসাম হারায় কাবাব-রা। রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয় হোক বা সত্যেন বোসের পদার্থবিদ্যা জয় বা জগদীশ চন্দ্র বসুর জীব বিজ্ঞানে জয়- এই সব ব্যক্তি কীর্তির আড়ালে দুর্বলই হচ্ছিল কাবাবরা। বাঙালি মুসলমান-দের পুনরুত্থানও ঠেকানো যায়নি বেশি দিন। একদিকে কাবাব-রা বিচ্ছিন্ন ভাবে ইংরেজ বিরোধিতা করতে থাকে আর অন্যদিকে ভারতীয় রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকে। চিত্ত রঞ্জন দাশ ও পরে সুভাষ বসু চেষ্টা করেছিলেন বাংলার রিয়েলিটি মেনে নিয়ে বাঙালি ও অবাঙ্গালি মুসলমান-দের সাথে জোট বাঁধতে কিন্তু কাবাব-দের মূল সমস্যা ছিল অ-কাবাব নীম্ন বর্ণের হিন্দুদের গুরুত্ব বাড়তে থাকা। মাহিষ্য জাতির বীরেন্দ্রনাথ শাসমল সুভাষ বসুর বিরোধিতা করেন। কাবাব-দের অধিকাংশ তখন মুসলমান বিরোধিতা ও হিন্দু ঐক্যের নামে অ-কাবাব নীম্ন বর্ণের বাঙালি হিন্দুদের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। বলা বাহুল্য পশ্চীম বঙ্গে যেখানে হিন্দু ঐক্য রাজনীতি দারুণ কাজ করছিল, পূর্ব বঙ্গে জমিদার বিরোধী শ্রেণি সংগ্রাম বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়। অধিকাংশ জমিদার কাবাব ছিল পূর্ব বঙ্গে। আর তাই নীম্ন বর্ণের হিন্দু ও মুসলমান জোট করে কাবাব-দের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গে। শেষ মেশ কাবাব-রা ১৯৪৬ থেকে ক্রমেই বাংলা ভাগের পক্ষে চলে যায়।
কাবাব-রা পূর্ব বঙ্গ থেকে অধিকাংশই পঃ বঙ্গে চলে আসে ১৯৪৭-৫০-এর মধ্যেই। ফলে তাদের ভারত রাষ্ট্রের নাগরীকত্ব নিয়ে কোনও সমস্যা থাকলনা। আবার দুই বঙ্গেই যেহেতু তাদের জনসংখ্যা শেয়ার ৭% ছিল তাই ১৯৫০-এর পরে পঃ বঙ্গে তাদের শেয়ার ১৩.৪% হয়ে যায়। এভাবেই পঃ বঙ্গে কাবাব-দের শাসন আবারও কায়েম হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে কাবাবদের প্রভাব প্রচণ্ড বাড়ে কিন্তু দিল্লীর অধস্তন হওয়ায় ব্যবসা মাড়োয়াড়িদের হাতেই থেকে যায়। দুনিয়া জুড়ে কমিউনিস্ট ভূমি সন্সকারের আন্দোলন পঃ বঙ্গে নিয়ে আনে কাবাব-রাই। তাদের নেতৃত্বে পঃ বঙ্গের মধ্য বর্ণের জোতদার শ্রেণি রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে যায়। তাই ভারতের অধিকাংশ রাজ্যেই মধ্য বর্ণ জোতদার-দের উত্থান হোলেও পঃ বঙ্গে উচ্চ বর্ণ-রা রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। তবে কাবাব-দের নেতৃত্বে থাকা বামফ্রন্ট সরকার পূর্ণ ভূমি সন্সকার করেনি। আধা ভূমি সন্সকার বা "অপারেশন বর্গা" করেছে। তাই কেবল জমিজাত উৎপাদনের ৫০% থেকে ৭৫% বর্গাদারকে দেওয়া হয়েছে মাত্র, জমির মালিকানা দেওয়া হয়নি।
তৃণমূলের শাসনও প্রচণ্ডভাবে কাবাব প্রভাবাধীন। এই আমলে কাবাব-রা বিশ্ব জুড়ে ইসলাম-এর যে উত্থান তাকে কাজে লাগিয়েছে। পঃ বঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা শেয়ার বাড়তে বাড়তে ৩০% থেকে ৩৫% হয়ে গেছে আজ। মুসলমান ভোট ব্যাঙ্কের ওপর দাঁড়িয়েই তৃণমূল মারফত কাবাব শাসন চলছে এখন পঃ বঙ্গে। কিন্তু দিল্লী ক্রমেই পঃ বঙ্গ, আসাম ও উঃ পূঃ বিহার জুড়ে মুসলমান জনসংখ্যা নিয়ে চন্তিত হয়ে পড়েছে। চীন বাংলাদেশ ও নেপাল মিলে এই অঞ্চলে অনেক কিছুই করে ফেলতে পারে। তাই কাবাব-দের ওপর এখন দিল্লী চাপ দেবে মুসলমানদের সাথে জোট ত্যাগ করতে। কিন্তু কাবাব-রা জানে পঃ বঙ্গ থেকে মুসলমান বিতারিত হলে তারা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলবে। ব্যবসা পুরোপুরি মাড়োয়াড়ি-দের হাতে, পঃ বঙ্গের নীম্ন বর্ণের হিন্দুরাও তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে কাবাব-দের উচ্ছ্বেদ করতে চায়। তাই পঃ বঙ্গে কাবাব-রাজের ভাগ্য এখন অনেকটাই বাঙালি মুসলমানের সাথে জোড়া। এছাড়াও বাঙালি মুসলমান-দের পেছনে চীন থাকবে। তাই খুব বুঝেশুনে এগোনো দরকার। সময়টা খুব খুব ক্রিটিকাল।
Author: Saikat Bhattacharya