আমার ২০০৯ সাল থেকেই এই ধারণা গড়ে উঠেছিল যে চীন-এর উত্থান একদিকে মার্কিন হেজিমনি ভেঙ্গে দেবে এবং গুজারাতি হিন্দি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়বে। আমার ধারণা ছিল মার্কিন হেজিমনি ভাংতে ভাংতে ২০৩৫ হবে আর গুজারাতি হিন্দি সাম্রাজ্য ভাংবে ২০৩৩ থেকে ২০৪০-এর মধ্যে। কিন্তু ২০২৫-এ এসে বোঝা যাচ্ছে যে মার্কিন হেজিমনি ভেঙ্গে পড়ছে আমার ধারণার অনেক আগেই।
২০১৭ সালে লাখভিন্দার সিং প্রথম আমাকে বোঝায় কেন ২০২৫-এই চীন-এর যুগ শুরু হয়ে যাবে। বর্তমানে বোঝা যাচ্ছে লাখভিন্দার সিং-এর ধারণাই সঠিক। ২০২৫-এ এসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বহু প্রযুক্তিতেই পেছনে ফেলে দিয়েছে চীন। শুধু তাই নয়, উদ্ভাবনের অর্থায়নে নতুন সমাজতান্ত্রিক মডেলও তৈরি করে ফেলেছে চীন যা মার্কিন পুঁজিবাদী উদ্ভাবন অর্থায়ন থেকে অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং লক্ষ্যপূরণে সক্ষম। উৎপাদনে চীন বহু আগেই মার্কিনকে পেছনে ফেলেছে। বাকি আছে মুদ্রার বাজার যেখানে মার্কিন ডলার এখনো শিক্তিশালী থাকলেও শক্তি ক্ষয় যে হচ্ছে তা দেখাই যাচ্ছে। ট্রাম্প যে চুক্তি চাইছেন চীনের সাথে, সেই চুক্তি হলেই মুদ্রার বাজারেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে অনেকটা জায়গা ছাড়তে বাধ্য হবে। দঃ এশিয়াতে বহু ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে গিয়ে গুজারাতি হিন্দি সাম্রাজ্য-কে আর সাহায্য করছেনা। অর্থাৎ মার্কিন সরকার চীনের সঙ্গে বিশ্ব ভাগ বাটোয়ারায় রাজী আর দঃ এশিয়া চীনের নিকটে বলে চীনের পকেটেই যাবে। এর অনিবার্য পরিণতি হল গুজারাতি হিন্দি সাম্রাজ্যের পতন। বোঝা যাচ্ছে আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যেই এই সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাবে।
২০৩০-৩৫ সালের মধ্যে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। ১৪০ কোটি সম্মিলিত চীনের সামনে ৩৫ কোটির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলে খুবই দুর্বল। কেবল শিল্পায়ণ ও আধুনিকিকরণ মার্কিন দেশে চীনের থেকে ১৮৩ বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে বলে মার্কিনীরা একটা সাময়ীক সুবিধে পেয়েছিল। যেভাবে ১ কোটির দেশ হল্যাণ্ড-কে ছাপিয়ে গেছিল ব্রিটেন আর ৬ কোটির দেশ ব্রিটেনকে ছাপিয়ে গেছিল ৩৫ কোটির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেভাবেই চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। হল্যাণ্ড-কে ছাপিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ব্রিটেন বাণিজ্য পুঁজিবাদের জায়গায় নিয়ে আনে উৎপাদন পুঁজিবাদকে আর ব্রিটেনকে ছাপিয়ে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আনে ফাটকা পুঁজিবাদকে। তেমনই মার্কিনীদের ছাপিয়ে গিয়ে চীন নিয়ে আনছে বাজার সমাজতন্ত্রকে। তাই চীনের জয়ের সাথে সাথে বাজার সমাজতন্ত্র প্রবল্ভাবে জয়ী হবে।
বাজার সমাজতন্ত্রের প্রথম প্রভাব পড়বে রাশিয়ার ওপর। রাশিয়া কমিউনিস্ট শাসনের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র থেকে উদারবাদ ও বহু দলীয় গণতন্ত্রে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। চীন কমিউনিস্ট শাসন বজায় রেখে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র থেকে বাজার সমাজতন্ত্রে গিয়ে সমৃদ্ধি পেয়েছে। পোল্যাণ্ড হাঙ্গেরী ছাড়া কোনও পূঃ ইউরোপীয় দেশই উদারবাদে গিয়ে লাভবান হয়নি। তাই রাশিয়াতে পুতিনের পরেই কমিউনিস্টদের পুনরুত্থান ঘটতে চলেছে। রুশ কমিউনিস্টরাও চীনের মতো বাজার সমাজতন্ত্র প্রয়োগ করবে। ক্রেমলীনে লাল পতাকা পুনরায় উত্থিত হলে বিশ্বের বহু দেশেই তার প্রভাব পড়বে। এমনিতেই বিশ্বায়ণ যুগে চীনের জয়জয়কার চলেছে। কোনও উদারবাদী বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশই বিশ্বায়ণের সুফল পায়নি। গুজারাতি হিন্দি সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার সাথে সাথে এটা সম্পূর্ণ রূপে প্রমাণ হয়ে যাবে যে অ-পশ্চীমা কোনও দেশেই উদারবাদী বহুদলীয় গণতন্ত্র কার্যকর নয়। পশ্চীমও জোর করে বহুদলীয় শাসন রেখে দিতে পারবেনা কারন পশ্চীমের তা করার মতো শক্তি আর থাকবেনা। তাই বিশ্বের বহু দেশই বাজার সমাজতন্ত্র প্রয়োগ করতে চাইবে।
বাজার সমাজতন্ত্রের প্রধান চরিত্র হল পুঁজিপতিদের ভোগ্যপণ্যের বাজারে গুরুত্ব দিয়ে পরিকাঠামোগত জায়গায় রাষ্ট্রকে দেওয়া। রাষ্ট্রের তৈরি পরিকাঠামো নির্মাণের ওপর ভোগ্যপণ্যের বাজার নির্ভর করবে আর এভাবেই পুঁজিপতিদের ওপর কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করবে। এছাড়াও বড় প্রতিষ্ঠানে কমিউনিস্ট দল মনোনিত ডিরেক্টর রাখা, একচেটিয়াকরণ আটকে দেওয়া, নতুন নতুন উদ্যোগীদের সুবিধে দিয়ে পুরনো পুজিপতিদের শেষ করে দেওয়া- এরকম অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পুঁজিপতিদের রেখে দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাজার সমাজতন্ত্র চলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের সমস্যা ছিল সেখানে আমলাদের হাতে গোটা উৎপাদন পদ্ধতি চলে যায়, এবং আমলারা স্তালিনের মৃত্যুর পরে নিজেদের পুঁজিপতিতে রূপান্তর করে। পশ্চীমা দেশগুলো শিল্পায়ণ সোভিয়েতের অনেক আগে থেকে শুরু করায় অনেক এগিয়ে ছিল বাজার এবং উৎপাদনে। সোভিয়েত প্রযুক্তিতে অনেক এগোতে পারলেও নতুন পণ্য উদ্ভাবনের কোনও সমাজতান্ত্রিক মডেল দাঁড় করাতে পারেনি। তাই পশ্চীমের থেকে অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া এবং আমলাদের পুঁজিপতি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষার ফলে সোভিয়েত ভেঙ্গে যায় এবং রাশিয়া সহ সোভিয়েতের সমস্ত প্রজাতন্ত্র উদারবাদী বহু দলীয় গণতন্ত্রের পথ গ্রহণ করে। চীন সোভিয়েতের থেকেও পিছিয়ে ছিল অর্থনীতিতে। তাই চীন রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র-এর জায়গায় বাজার সমাজতন্ত্র নিয়ে আনে এবং কমিউনিস্ট শাসন অটুট রাখে। চীন এটা করতে পেরেছে কারণ চীনে একটা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা কেন্দ্রীক আমলাতন্ত্র বিদ্যমান আছে ২ হাজার বছর আগে থেকেই। বংশ পরম্পরায় নয়, পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে আমলা হওয়ার পরম্পরা আমলাদের সরাসরি পুঁজিপতি হতে একটা সামাজিক বাঁধা হিসেবে কাজ করে চীনে। এছাড়াও মাও-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনে একটা শক্তিশালী শ্রেণি চেতনা তৈরি করতে পেরেছিল। এই শ্রেণি চেতনাও আমলাদের পুঁজিপতি হতে বাঁধা দেয়। স্তালিন সোভিয়েতে কোনও সাংস্কৃতিক বিপ্লব না করায় সেখানে শ্রেণি চেতনা ছিল দুর্বল। এছাড়াও সোভিয়েত-দের অনেকেই শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় পশ্চিম-এর প্রতি সদ্ভাবও পোষণ করত। পশ্চীম ও অ-পশ্চীমের মধ্যেকার যে বৈষম্য তা নিয়ে সোভিয়েতের একটা বড়ো শ্বেতাঙ্গ জনসংখ্যা চিন্তিত ছিলনা। ফলে পশ্চীমের উদারবাদকে মেনে নিয়েছিল। চীন অন্যদিকে পশ্চীমের সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন রূপ দেখেছে। পশ্চীমের প্রতি চীনের অবিশ্বাস ছিলই। কমিউনিস্ট দলের নেতৃত্ব ছাড়া চীন পশ্চীমা সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করতে পারতনা। ফলে চীনে কমিউনিস্ট দলের পক্ষে জনমত ছিলই। তাই চীন বাজার সমাজতন্ত্রের পথ ধরে এগিয়ে গেছে আর রাশিয়া উদারবাদী বহুদলীয় গণতন্ত্রে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে।
এবার প্রশ্ন ২০৩০-৩৫ সালের মধ্যে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ার পরে দুনিয়া জুড়ে বাজার সমাজতন্ত্রের ঝড় উঠবে কি না? উত্তর হল অবশ্যই ওঠার প্রবল সম্ভাবনা আছে। পশ্চীমা অর্থনীতি গুরুত্ব হারালে পশ্চীমা ব্যঙ্কে অর্থ জমানো কঠিন হবে তৃতীয় বিশ্বের শাসকদের। তখন তৃতীয় বিশ্বের শাসক শ্রেণিগুলো খুবই দুর্বল হয়ে পড়বে। শাসিত শ্রেণির ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার ওটাই সময়। এই সময় ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মের সাথে কিভাবে গাটছড়া বেঁধে এগোবে কমিউনিস্টরা তার ওপর পুরো পরিস্থিতি নির্ভর করছে। আমার ধারণা ২০৩০-এর পরে আমরা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের বিপ্লব দেখব যা বিংশ শতকের মার্ক্সবাদ লেনিনবাদ-এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। আমি একে বলব তৃতীয় বিপ্লবী ঢেউ।
Read MoreAuthor: Saikat Bhattacharya
International geopolitics General Socialism Communism Xi Jinping Mao USSR China 22-May-2025 by east is risingবাংলাদেশের জেন-জি তরুণ প্রজন্ম লড়াই করে হাসিনা আওয়ামী ও ভারতকে হটিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব বৌদ্ধিক দিক দিয়ে অক্ষম। তারা বুঝেই উঠতে পারেনি হাসিনা আওয়ামী বিএনপি সবই মুখোশ। আসল সমস্যা হল বাংলাদেশের শাসক লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণি। এরা সর্বত্র সিণ্ডিকেট বানিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা চালাতে চায়। এরাই আওয়ামী আর বিএনপি-কে চালায়। প্রয়োজনে জামাত এবং এনসিপি-কেও এই লুটেরা পুঁজি কিনে নেবে। তাই জুলাই বিপ্লবীদের উচিত ছিল অর্থনৈতিকভাবে এই লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণিকে কোণঠাসা করা। তাদের একচেটিয়া কারবার রুখে দেওয়া। নতুন প্রজন্ম-এর ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করা যাতে প্রতিযোগিতা বাড়ে এবং যেখানে পরিকাঠামোতে রাষ্ট্র-কে নিয়ে আনা। চীনের কাছ থেকে শেখা কিভাবে পরিকাঠামোতে রাষ্ট্রীয় মালিকানা রেখে ভোগ্যপণ্যে প্রতিযোগিতামূলক ব্যক্তি মালিকানা চালায়। কিন্তু বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবী নেতারা অর্থনৈতিক চিন্তা করতেই পারেনা।
জেন-জি নেতা-দের বৌদ্ধিক অক্ষমতার ফল দাঁড়ায় বিপ্লবের পরে বৌদ্ধিক কাজের দায়িত্ব তারা দিয়ে দেয় বুমার জেনারেশন-কে। এই বুমার জেনারেশন-এর পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি আজকের প্রজন্মের আশা আকাঙ্খা। আর বাংলাদেশের বুমার জেনারেশন কোনও দিনই বাংলাদেশের লুটেরা শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে কোনো সংরাম করেনি। তাই বুমার ও জেন-এক্স বহু ক্ষেত্রেই ভুল পদক্ষেপ নিচ্ছে।
যেখানে জুলাই বিপ্লবের শ্লোগান উঠেছিল "নারী যেখানে অগ্রসর, কোটা সেখানে হাস্যকর"। অর্থাৎ বাংলাদেশের নারী নিজেদের অগ্রসর মনে করছে ও তারা নারী কোটা চাইছেনা। জেন-জি প্রজন্মের এই আকাঙ্ক্ষার উলটো দিকে হেটে বুমার ও জেন-এক্স নেতৃত্ব নিয়ে আনল নারী কোটার পক্ষের নারী বিল। স্বাভাবিকভাবেই নতুন প্রজন্মের বিশাল একটা অংশ-কে নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।
অন্তর্বর্তীকালীন বুমার ও জেন-এক্স নেতৃত্ব ভালো করে বোঝাতেই পারলোনা যে রাষ্ট্রসংঘের অনুমতি নিয়ে মানবিক করিডোর করার অর্থ চীন রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তিন শক্তির থেকেই অনুমতি নেওয়া। এমনকি মিয়ানমারেরও অনুমতি নেওয়া। তিন শক্তির একজনেরও অসম্মতি থাকলে রাষ্ট্রসংঘে পাশ হবেনা কারণ সে ভেটো দেবে।
সেভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্ব বোঝাতে অক্ষম হচ্ছে যে ডিপি-ওয়ারল্ড একটা আরব আমীর শাহী-এর কম্পানী। এই কম্পানী চীনের ছিংদাও প্রদেশের ৪টে বন্দর দেখাশোনা করে এবং চীনের তিয়ানজিন ও হংকং বন্দরও এদের জিম্মায়। তাহলে ডিপি-ওয়ারল্ড-কে চট্টগ্রাম বন্দর দেওয়া কিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কে বন্দর দেওয়া হয়? এসব কথা রটাচ্ছে সেই লুটেরা শাসক শ্রেণি যারা বন্দরে সিন্ডিকেট-এর একচেটিয়া কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে চায়। বুমার ও জেন-এক্স নেতৃত্ব এই মিথ্যে প্রচারের বিরোধিতা করতে পারছেনা। আর জেন-জি নেতৃত্ব বৌদ্ধিক দিক থেকে বিকলাঙ্গ। ফলে আওয়ামী গেলেও শাসক শ্রেণির অর্থনৈতিক শাসন বজায় আছে পুরোপুরি। আর তারা সমস্ত দলকেই কলকাঠি নেড়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। মিডিয়ও তাদের হাতে। প্রশাসনও। এই লুটেরা পুঁজির শাসন-কে চ্যালেঞ্জ করাই মূল কাজ।
Author: Saikat Bhattacharya
International geopolitics General world order 22-May-2025 by east is rising